নাবিকের সমুদ্র কথন-৮৬ : ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
636

দিন শুরু হল রাত বারটায় আর বারটা বাজেই ব্রিজে এসেছি। ব্রিজে এসেই একটু ধাক্কা খেয়েছি, সারাদিন আবহাওয়া ‘চপি’ ছিল। চপি বলতে আমরা বুঝাই যে সাগর একটু উত্তাল, তেমন কোন ঝড় বয়ে যাচ্ছে না কিন্তু অশান্ত। এর সাথে ছিল মেঘলা আকাশ আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। কিন্তু এখন বহির্নোঙ্গরের অবস্থা কিছুটা ভয়াবহ বলা যায়। বাতাসের গতি ৬০কিমি এর কাছে, তার চেয়ে বাজে অবস্থা হল উত্তাল সাগরের সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর কুয়াশা, সব মিলিয়ে দৃষ্টিসীমা অন্ধকার। মাত্র ১ মাইল দুরের জাহাজ ধোয়াটে লাগছে। মাঝ সাগরে এরকম আবহাওয়া তেমন কোন ঝামেলার ব্যাপার না, কিন্তু নোঙরের এই ভীরের মধ্যে এসে এরকম আবহাওয়াতে এই জলহস্তীকে যায়গা মত নিয়ে যাওয়া কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ। ঢাকা চিটাগাং মহা সড়কের পাশে খোলা জায়গায় একটি বিশাল ট্রেইলার ট্রাক পার্ক করা যেমন কোন সমস্যা না, কিন্তু বড় একটি ট্রাক ঢাকা শহরের কোন পার্কিং লটে অসংখ্য ছোট বড় গাড়ির মাঝে ঢুকান ঝামেলার ব্যাপার। ব্রিজে এসেই ইঞ্জিন স্ট্যান্ড-বাই দিয়েছি। বহির্নোঙ্গরে ঢুকব ঢুকব অবস্থা। গতি কমাতে শুরু করেছি ধীরে ধীরে, ১০কিমি গতিতে আসলে ইঞ্জিন পেছনে চালিয়ে দেখব একবার, তারপর রওনা হব নোঙরের দিকে। বেশ অনেকদিন একদম পরিষ্কার আবাহাওয়ার পর আজকে হটাত এই ইউরোপের মত আবহাওয়াতে এসে থমকে গেছি। জেরি বলল বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে যেকোনো জায়গায় এঙ্কর করতে পারি, এঙ্কর করা হয়ে গেলে তাদের যাতে জানিয়ে দেই। প্রথমে ইচ্ছে ছিল জাহাজ গুলির মাঝখান দিয়ে ভেতরে চলে যাব, সেখানে একটি জায়গাতে প্রায় ৪ কিমি বাই ৪ কিমি একটা খালি জায়গা আছে। কিন্তু সেখানে যেতে হবে দুটি জাহাজের মাঝ খান দিয়ে।

আমার মধ্যে কোন কুসংস্কার কাজ করেনা, কিন্তু তারপরেও আজকে কেন জানি মনে হল এই ৬০ কিমি ঝড়ো বাতাসে এই দুটি জাহাজের ভেতর দিয়ে ঢুকব না। আমার আগের জাহাজটি আমি সাইন অফ করার দু মাস পর সিঙ্গাপুরে বড় একটি সংঘর্ষ করেছিল। হটাত সে কথাটি কেন জানি আজকে মনে হল। খুবই অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন ছিলেন, এবং একদম শান্ত ও খোলা সমুদ্রে নোঙর করতে গিয়ে আরেকটি নোঙরে থাকা জাহাজকে গিয়ে ধাক্কা মেরেছিলেন, দু জাহাজই মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আমি এই দুর্ঘটনার ভিডিওটি দেখেছিলাম। ভিডিও মানে আমাদের ব্ল্যাক বক্সে র‍্যাডার ও ইলেকট্রনিক ম্যাপ এর রেকর্ডিং। মাথায় ঢুকেনি কিভাবে এটা সম্ভব হল। ক্যাপ্টেন সাথে দুই সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিল, সবাই সতর্ক ছিল, সবার কথার রেকর্ডিং শুনছিলাম, তার পরেও মনে হলে ইচ্ছে করে পায়ে পারা দিয়ে ঝগড়া লাগাল। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের এক জাহাজে আমার ক্যাপ্টেন ছিলেন ১০ ব্যাচের ক্যাপ্টেন শাহ আলম স্যার। উনি একদিন একটি কথা বলেছিলেন যা আমি এখনও মাথায় রাখি। উনি বলেছিলেন ন্যাভিগেটর হিসেবে জীবনে শুধু একটি চান্স বা সুযোগ পাবে। মানে শুধু একটা ভুল করা যাবে, সেটাই আমার ন্যাভিগেশন এর সমাপ্তি, আর নাবিক জীবনের অপমৃত্যু। এমনি গাড়ি এক্সিডেন্ট করলে হয়তো লাইসেন্স কিছুদিন এর জন্য সাসপেন্ড হয়, আবার ড্রাইভিং এর চাকরী পেয়ে যায়।

জাহাজে একজন চীফ ইঞ্জিনিয়ারের ভুলে ইঞ্জিন এর এর ব্যাপক কোন সমস্যা হলে বা ইঞ্জিন ব্রেক ডাউন হলে হয়তো কোম্পানি তে তার সুনাম কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়, খুব বেশী হলে তার চাকরী চলে যাবে এবং নিশ্চিন্তে আরেক কোম্পানিতে চাকরী পেয়ে যাবে। কিন্তু একজন ক্যাপ্টেন জাহাজ নিয়ে আরেকটি জাহাজের সাথে দুর্ঘটনা ঘটালে বা সংঘর্ষ করলে তার নাবিক জীবনের ইতি ঘটবে বলা যায়। কোন কোম্পানিই কলিশন এর সাথে যুক্ত একজন ক্যাপ্টেন কে চাকুরী দেয় না, যদি না একদম পরিষ্কার ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয় যে এতে তার বিন্দুমাত্রও ভুল ছিল না। আগের দিনে এসব লুকানো যেত, কিন্তু এখন এরকম ঘটনা ঘটলে এগুলি আন্তর্জাতিক ভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়, তাই এসব ঘটনা গোপন করে নূতন কোন কোম্পানিতে চাকুরী নেয়া অসম্ভব। কেন জানি মনের খুঁত খুঁতে ভাবটি দূর হচ্ছিল না। কুসংস্কারে অবিশ্বাসী হবার পরেও এরকম একটি ঘটনা হটাত মনে পরে যাওয়াতে মনে হয় আমি আরও সতর্ক হয়ে গেলাম। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম এই ভিড়ের ভেতর ঢুকব না, সবাইকে পাস কাটিয়ে একদম অপর প্রান্তে গিয়ে খোলা জায়গায় নোঙর করলাম। নোঙর করা শেষ করে ক্যাবিনে ফিরতে বাজলো প্রায় তিনটা। যদিও সন্ধ্যায় ঘুমাইনি, তারপরেও কেন জানি ঘুম চলে গেছে। আগের দুদিনের দিনলিপি লিখা হয় নি, সেগুলো নিয়ে বসলাম। সব শেষে ঘুমলাম রাত ৪টার দিকে। ঘুম ভাঙল ১০টায়, আবহাওয়া এখনও সেই আগের মতই। সূর্যের দেখা নেই সেই কালকে থেকে। এর সাথে তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি’র মত। বৃষ্টির জন্য ডেকে কাজ নেই, ক্রুরা একোমোডেশনের ভেতরে কিছু কাজ করছে। এদিকে এজেন্ট থেকে কয়েকটি মেইল এসেছে, অনেক কাগজ পত্র পাঠাতে হবে, প্রশ্নের উত্তর পাঠাতে হবে। দেখলাম আবদুল আগে থেকে সব প্রস্তুত করে রেখেছে, কিন্তু পাঠায় নি। আমারও এসব নিয়ে আর বসতে ইচ্ছে হল না। এক দুই লাইনের যেসব মেইল সেগুলি আমি উত্তর দিয়ে দিলাম, বাকি গুলো বিকেলে আবদুল ডিউটিতে আসলে পাঠানো হবে।

এজেন্টের কাছ থেকে বার্তা এসে গেছে যে আমরা ৩০ তারিখ ভোরে বন্দরে ঢুকব, এর সাথে ভালো খবর হল এ বন্দরে পানি পাওয়া যাবে। অনেক দিন পরে জাহাজ পানিতে পরিপূর্ণ করা হবে, পানি নিয়ে আর কার্পণ্য নেই। মাসের বাকি কিছু ড্রিল আছে সেগুলি আজকে শেষ করতে হবে। আজকের ড্রিল হবে ইঞ্জিনরুম এ আগুন লাগার ঘটনা। এ মাসের প্রথম দিকে ড্রিল টি করা হয়েছিল, কিন্তু সেটি ছিল অনেকটা প্রশিক্ষণ এর মত। আজকে সবাইকে বললাম এটি একটি পরিপূর্ণ ড্রিল হবে। ড্রিল এর সময় আমি ব্রিজে থাকি, কিন্তু আজকে ড্রিল এর সাইরেন বাজানোর পর আমিও নীচে চলে গেলাম তাদের প্রস্তুতি ও কর্ম পদ্ধতি দেখার জন্য। প্রধান উদ্দেশ্য ইঞ্জিন রুমে আগুন লাগলে কিভাবে ভেতরে যেতে হবে, কোন দরজা ব্যাবহার করতে হবে, ব্রিদিং এপারেটাস, মানে বাতাসের সিলিন্ডার পিঠে নিয়ে কিভাবে যেতে হবে এসব। কিভাবে হাটতে হবে, অন্ধকারে কিভাবে রাস্তা খুঁজে নেবে এসব কিছুর উপরে যাতে জোর দেয়া হয়। চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর চীফ অফিসার কে বললাম এরা সবাই যাতে টিম এর সাথে থাকে, অন্যান্য ক্রুরাও যাতে থাকে। প্রতিটা পদক্ষেপে যাতে তাদের দেখিয়ে দেয়া হয়, অন্য সব ক্রুরাও যাতে দেখে আসলে কিভাবে অগ্নি নির্বাপক টিম কাজ করে। এক টিম এর কাজ শেষ হলে আবার আরেক টিম এটির পুনরাবৃত্তি করবে। আজকে এর উপরেই প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা কর হবে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে ড্রিল শুরু হল, শেষ হল পাঁচটা বাজে। প্রায় দের ঘণ্টা শুধু এই পদ্ধতির উপর ব্যয় করা হল। পাঁচটা বাজে ড্রিল শেষ করার পর ডেক অফিসারদের ব্রিজে আসতে বললাম। ডেক অফিসার দের সাথে এটা আমার মীটিং, মীটিং না বলে নসিহত দেয়া বলা চলে। অনেকদিন একটু নাড়াচাড়া না করলে লোকজন একটু ঢিলা হয়ে যায়, তাই সবাইকে ডেকে বিগত কয়েক সপ্তাহে করা কিছু ভুল ও ত্রুটি দেখিয়ে দেয়া এবং সতর্ক করে দেয়া। মীটিং এ আমার অসন্তুষ্টির বিষয় গুলি জানিয়ে দিলাম। তারা অনেক সময় আগে থেকে প্রস্তুত থাকে না, তাদের পরিকল্পনা তে কিছু ত্রুটি আছে সেগুলি দেখিয়ে দিলাম। সেদিন পাইলট নেমে যাবার সময় ডিউটি অফিসার ভুলে গিয়েছিল সারেং কে বলে প্রস্তুত থাকতে। কিন্তু সে যখন নামতে যাবে দেখা গেল কেউ ওয়াকিটকি তে নেই। কিন্তু চীফ অফিসার ছিল কন্ট্রোল রুমে, সে গিয়ে দ্রুততার সাথে কাজটি শেষ করে। জাহাজ বাধার সময় ডিউটি অফিসাররা অনেক সময় ওয়াকিটকি নিয়ে যায় কিন্তু সেটি কোমরে বাধার বেল্ট নিয়ে যায় না। ফলে তারা ওয়াকিটকি হাতে রেখে কাজ করে। অনেক সময় কোন কাজে দুহাত ব্যাবহার করতে হয়, তখন ওয়াকিটকি পকেটে রাখে। সে সময় দেখা যায় আমি ওয়াকিটকিতে ডাকছি, কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না, এগুলুতে আমি চরম বিরক্ত হই। এসব খুঁটি নাটি বিষয় আজকের বিষয় বস্তু।

সব শেষে জেরির বিষয়টি উত্থাপন করলাম, সবাই জানে জেরি ক্যাপ্টেন কে ব্রিজে ডেকে ছিল, ক্যাপ্টেন ব্রিজে ছিল রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত, কিন্তু কেউই পরিষ্কার ভাবে জানেনা কি হয়েছিল, কি পরিস্থিতিতে জেরি ডেকেছিল। আমি শুরু করলাম জেরিকে প্রশ্ন করে ‘জেরি তুমি কি আত্মবিশ্বাসী একা জাহাজ চালাতে’? জেরি আমতা আমতা করে বলল যে সে আত্মবিশ্বাসী। তারপর বললাম তুমি কি জানো কখন এবং কি পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন কে ব্রিজে ডাকতে হবে? এবার জেরির চেহারা ফেকাসে হয়ে গেল। জেরি ধরে নিলো আমাকে ডাকাতে আমি তার সক্ষমতার উপর সন্দেহ প্রকাশ করছি। তারপর সবাইকে চার্ট টেবিলে ডেকে নিয়ে গেলাম, জেরিকে বললাম চার্ট বের করে দেখাও কোথায় আমাকে ডেকেছিলে। জেরি ততক্ষণে মোটামুটি কাঁপছে যে এর পর না আর কি আসে। ম্যাপ টেবিলে বিছিয়ে রাখার পর সবাইকে দেখালাম যে জেরি আমাকে এখানে ডেকেছে এবং প্রায় সোয়া ঘণ্টা আগে আমাকে ডেকেছে। সবাইকে বুঝালাম জেরি কোন পরিস্থিতিতে আমাকে ডেকেছে, আর সব শেষে বললাম জেরি যেটা করেছে সেটাই আমি সবার কাছ থেকে আশা করি। যে শেষ মুহূর্তে নয়, যদি তার মনে হয় পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হবেনা, তাহলে ক্যাপ্টেন কে আগেই ডাকো, তাহলে সে এসে শান্ত মাথায় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে পারবে। আমি আসলে জেরিকে একটু সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, এবং আমার সারপ্রাইজ টা কাজে লেগেছে। জেরির ফ্যাঁকাসে মুখে প্রথম হাসি ফুটল। সব শেষে জেরি কে ধন্যবাদ জানিয়ে মীটিং শেষ করলাম। আজকের দিনটি গিয়েছে এমনিতে ঝড়ো হাওয়া, ঠাণ্ডা কুয়াশা ঘেরা একটি প্রানহিন দিন। কাজ কর্ম ও তেমন হয়নি, সবাই যেমন অলসতায় ভুগছে। আমার লেখাতেও অলসতা আজকে, তাই এখাইনেই দিনের শেষ করা হল। সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, শুভরাত্রি। (২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ ভাসমান ৮৬ দিন: বুধবার।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে