নাবিকের সমুদ্র কথন-৮৫ : ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
656

ঠিক বারটা বাজে মানে আমাদের ভাষায় ০০:০০ ঘটিকা তেই আমরা পরবর্তী বন্দরের জন্য ফুল এওয়ে দিলাম, সেই সাথে শুরু আরেকটি ভয়েজ, সাথে শুরু আমার আরেকটি দিন। যাত্রা পথের প্রথম ১৪০কিমি এর মত নিরাপদ ট্রাফিক লেন দিয়ে, মানে ম্যাপে আকা এই লেন অনুসরণ করে যেতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন পুলিশ বিভাগ থেকে একটি ম্যাপ বের করে, সেখানে দেখানো থাকে শহিদ মিনার, পলাশী, আজিমপুর ও বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ঢাকাতে সেদিন কোন কোন এলাকা দিয়ে চলাচল করা যাবে। এখানকার এই ম্যাপটিও তেমন, ফ্লোরিডা থেকে মেক্সিকো সীমান্ত পর্যন্ত সাগরের উপকূলীয় এলাকাটির মধ্যে বেশ অনেক গুলি রাস্তার মত টানা আছে, এই রাস্তা ফ্লোরিডা, লুসিয়ানা, টেক্সাস এই তিন উপকূলীয় অঙ্গ রাজ্যের বন্দর গুলিকে সংযুক্ত করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি’র দিনে কেউ যদি শহিদ মিনার, আজিমপুর কবরস্থান বা টিএসসি এলাকায় আসতে না চায় তাহলে এই ম্যাপের বাইরে দিয়ে যাতায়াত কড়াই ভাল। কিন্তু যদি এই এলাকায় ঢুকতে হয়, তাহলে ডিএমপি’র ম্যাপ ধরে এগুনো ভাল। আমরা লেক-চার্লস বন্দর থেকে যাব করপাস-ক্রিস্টি। সোজা গেলে দূরত্ব ৫৫০ কিমি এর মত। কিন্তু আমাদের করিডোর অনুসরণ করে যেতে হবে। তাই আমরা বন্দর থেকে দক্ষিণে গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যাব, এর পর আবার পশ্চিম দিকে সোজাসুজি গেলে করপাস ক্রিস্টি পৌঁছে যাব। দূরত্ব দাঁড়াবে ৭০০ কিমি এর মত। পুরো রাস্তাটি আমরা করিডোরের ভেতর দিয়ে যেতে পারি, কিন্তু তাতে এই পুরো ২৪ ঘণ্টা ব্রিজে অতিরিক্ত একজন অফিসার থাকতে হবে, ইঞ্জিন রুম সবসময় দুজন ইঞ্জিনিয়ার থাকতে হবে। সেজন্য আমরা ১৪০ কিমি দক্ষিণে গিয়ে এই এলাকা থেকে বেড়িয়ে যাব, তারপর সাধারণ ন্যাভিগেশনে বাকি রাস্তা টুকু অতিক্রম করব। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে আমি গুলিস্তান থেকে নিউ মার্কেট যাচ্ছি, চনাখার পুল, পলাশী, আজিমপুর হয়ে গেলে সোজা, কিন্তু ঝামেলা মুক্ত রাস্তা হল গুলিস্তান থেকে সোজা উত্তর দিকে মালিবাগ গিয়ে সেখান থেকে বাংলা মটর হয়ে আরও পশ্চিমে গ্রীন রোড দিয়ে নিউমার্কেট যাওয়া। জেরি কে সব বুঝিয়ে দিলাম, ইঞ্জিন রুম কে বললাম রাত বারটায় আমাদের ‘আর-ও-বি’(Remain On Board)বা জাহাজে কি পরিমাণ তেল আছে সেটা জানাতে। আমরা যখনি ফুল-এওয়ে দেই, সেই সময়ে জাহাজে কি পরিমাণ তেল ও পানি আছে সেটা পরিমাপ করা হয়, এবং অফিসে যে বার্তাটি পাঠানো হবে সেখানে এটি দিতে হয়।

চীফ ইঞ্জিনিয়ার এটি হিসেব করে জানালে আমি মেসেজটি পাঠিয়ে দিয়ে নিজেকে ছুটি দিয়ে দেব। রাত্র পৌনে একটায় জেরি জানালো যে চীফ ইঞ্জিনিয়ার তেল এর হিসেব দিয়ে দিয়েছে, আমিও সাথে সাথে ব্রিজে গিয়ে বহির্গমন বার্তাটি পাঠিয়ে ব্রিজ থেকে নেমে আসলাম। ঘুম এসে গিয়েছিল, তাই অন্যদিনের মত ফেইসবুকে সময়ক্ষেপণ না করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলাম। চোখ তখন মাত্র লেগে এসেছে, ফোনের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। জেরির ফোন, স্যার দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, কিন্তু আমি একটি অবস্থার মুখোমুখি, আপনার সহায়তা প্রয়োজন। ব্রিজ থেকে ডিউটি অফিসার এর ফোন ব্যাপারটা কখনোই সাধারণ নয়, পরিস্থিতি ঘোলাটে না হলে ব্রিজ অফিসার ক্যাপ্টেন কে ডাকেনা। আরেকটি ব্যাপার হল, যে সকল পরিস্থিতিতে কোন সমস্যা হতে পারে, ক্যাপ্টেন ব্রিজেই থাকে। ক্যাপ্টেন তখনই ব্রিজ ত্যাগ করে যখন সে নিশ্চিত থাকে যে আগামী ৬/৭ ঘণ্টায় কোন সমস্যা সৃষ্টি হবে না, কারণ আমরা র‍্যাডারে দেখে আগামী ৬/৭ ঘণ্টা সম্বন্ধে ধারণা নিতে পারি। জেরি জানালো যে আমরা গুলিস্তান থেকে মালিবাগের দিকে আগাচ্ছি, কিন্তু আরেকটি জাহাজও, মালিবাগ মোরের দিকে আগাচ্ছে এবং একই সময়ে আমরা ওখানে পৌঁছব। ঢাকা শহরের সাপেক্ষে দুইটি গাড়ি এসে একটি মোড়ে মিলবে, এটা খুব সাধারণ ব্যাপার, আমরা গাড়ি ব্রেক করব, বা একটু ধীরে চালাবো, আরেকটি গাড়িকে যেতে দেব। কিন্তু সাগরে এটা সাধারণ ব্যাপার না, করিডোর গুলি খুব বেশী চওড়া না তারপর আমাদের ব্রেক নেই, জাহাজ ফুল-এওয়ে তে চলছে, পূর্ণ গতিতে, এসময় তার গতির পরিবর্তনও ততটা সহজ নয়। জেরি কে জিগ্যেস করলাম কত দূরে আমরা সেই তিন রাস্তার মোড় থেকে।

জেরি জানাল আমরা প্রায় ৩০ কিমি দূরে। আমি মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলাম তার এই নিজের প্রতি আস্থাহীনতা দেখে। এত আগে সে আমাকে ডেকেছে, সেখানে পৌছাতে আমাদের আরও ঘণ্টা খানেক লাগবে। আমি জেরির প্রতি কিছুটা বিরক্ত হলেও আমার গলার স্বরে কিছুই প্রকাশ হতে দিলাম না যে সন্দেহ করতে পারে যে আমি কিছুটা হলেও নিরাশ তার ব্যাপারে, তাহলে ভবিষ্যতে আমাকে ডাকতে সে ভয় পাবে যা নাকি আরও বিপদজনক। আধা ঘণ্টা পর ব্রিজে গেলাম, গিয়ে দেখলাম পরিস্থিতি আসলেই একটু জটিল। অপর জাহাজটি উল্টো দিকে থেকে আসছে না, কোনা কুনি আরেকটি গলিপথ দিয়ে আমাদের পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে, এবং সেই জাহাজটির পেছনে আরেকটি জাহাজ আছে। জেরির প্রতি আমার যে কিঞ্চিৎ বিরক্তি’র সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা প্রশংসায় পরিবর্তিত হল। পরিস্থিতি একজন ক্যাপ্টেন এর কাছে তত জটিল না হলেও একজন ডিউটি অফিসারের কাছে অবশ্যই এটা জটিল। জেরি জানতে চাইল ইঞ্জিনরুম কে বলব নাকি গতি কমানোর জন্য? মানা করলাম। জাহাজে আমরা আমাদের কোর্স বা দিক পরিবর্তন করেই সমস্যার সমাধান করতে চাই, গতি’র উপর হাত দিতে চাই না। প্রায় রাত তিন টা বাজে আমরা নিরাপদে মালিবাগ মোড় অতিক্রম করে গেলাম। জেরি কে বললাম এখন আর কোন অসুবিধা আছে কিনা। সে আমাকে বলল এখন আর অসুবিধা নেই, বাকি পথে সে আর সমস্যা দেখছে না, এবং কথার ফাকে ফাকে বেশ কয়েকবার আমাকে ধন্যবাদ জানাল। ধন্যবাদ যে আমি তাকে মনে মনে দিচ্ছি সেটা তাকে বুঝতে দিলাম না ইচ্ছে করেই। এমনি তে আগামীকাল ন্যাভিগেটিং অফিসারদের নিয়ে একটি মীটিং করার ইচ্ছে, ব্যাপারটা তখন সব অফিসারদের সামনেই আলাপ করতে চাই। সঠিক সময়ে ক্যাপ্টেনকে ব্রিজে ডাকতে যাতে কেউ দ্বিধা না করে সেটা সবাইকে বুঝানো এবং জেরি যে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটার প্রশংসা সবার সামনেই করব যাতে জেরির আত্মবিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়।

রাতে ব্রিজ থেকে এসে ঘুমাতে ঘুমাতে বেজে গিয়েছিল প্রায় চারটা, তাই সকালে ঘুমালাম সকাল ১০টা পর্যন্ত। ঘুম থেকে উঠে অনেকটা আশা নিয়ে গেলাম নিচের দিকে, যদি ইসমাইল এর দেখা পাওয়া যায়। নীচে গিয়ে দেখলাম সব নির্জন। কফি খাওয়ার ইচ্ছেটা দমন করার জন্য নিজেই বানালাম ইসমাইল কফি। একেবারে খারাপ হলনা, কফি নিয়ে উঠে এলাম ব্রিজে। জাহাজ ছুটছে পরবর্তী বন্দরের দিকে কিন্তু আমাদের ভয়েজ-অর্ডার এখনো আসেনি। সমস্যা সেটা নয়, সমস্যা হল কোন বন্দরে যেতে হলে আমাদের ইলেকট্রনিক নোটিশ পাঠাতে হবে, অনেকটা জাহাজের ইমিগ্রেশন এর মত। এই নোটিশটি তে আমাদের এজেন্ট এর সমস্ত বিষদ বর্ণনা থাকতে হবে।

ভয়েজ অর্ডারে দেয়া থাকবে এজেন্ট এর বর্ণনা। ফোন করলাম আমার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক কে, ভ্লাদিমির নেই ডিউটিতে, আছে অস্টিন। না ফোনে স্বয়ংক্রিয় বার্তা চলে এলো, একটি টোন এর পরে যাতে আমার বক্তব্য ও আমার ফোন নাম্বার বলে দেই, তাহলে সে যত দ্রুত সম্ভব আমাকে ফোন করবে। কোন বার্তা রাখলাম না, এমনিতে সে মিস-কল হিসেবে এই নাম্বার দেখেবে।
আজকে ক্রিসমাস পার্টি, ২৫ তারিখে সম্ভব হয়নি তাই আজকে করা হচ্ছে। চীফ কুক আর সেকেন্ড কুক কে দেখলাম ভয়ানক কসরত করছে তাদের প্রস্তুতি নিয়ে, তাদের সহায়তায় আলী ও ইঞ্জিন ক্যাডেট জাফরী। বারটা বাজে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে বড়দিন এর বড় লাঞ্চ এর। চীফ কুক ও সেকেন্ড কুক দুজনেই খ্রিষ্টান, সুতরাং তাদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা তুঙ্গে। চীফ কুক বেশ গর্বের সাথে বলল যে দুইটি টেবিলেও নাকি কম পরে যাবে তার আয়োজন রাখার জন্য। বারটার মিনিট পাঁচেক আগে ঘোষণা দেয়া হল সবাই যাতে ক্রু-মেস রুমে যায় বড়দিনের বিশেষ মধ্যাহ্ন ভোজে অংশগ্রহণ করার জন্য। আমি এই ফাকে গোসল করে একটু পরিপাটি হয়ে নিয়েছি। আলাদা করে তেমন কোন কাপর আমি রাখিনা কোন পার্টি’র জন্য, কিন্তু তারমধ্যেও সবচেয়ে কম পরা হয়েছে এমন একটি পোশাক পরে নিলাম, যাতে ভোজের মান হানি না হয় এবং সবাই যাতে বুঝতে পারে আমি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করছি এই বিশেষ আয়োজনটিকে।

চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর আমি এক সাথেই গেলাম ভোজ সভায়। ক্রিসমাসের দিনে চীফ ইঞ্জিনিয়ার তার বাংকার বা জ্বালানী তেল নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তাই হয়তো কারো সাথে দেখা করা হয় নি। আমি নিজে অবশ্য জনে জনে সমস্ত খ্রিষ্টান ধর্মালম্বিদের সাথে শুভেছা ও সৌহার্দ বিনিময় করে এসেছিলাম। চীফ ইঞ্জিনিয়ার সবার সাথে হাত মিলাল, মেরি ক্রিসমাস বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করল। আমি সবাইকে বললাম যে দ্বিতীয় বার ক্রিসমাস। এর পর শুরু হল চিত্রগ্রহণ, সবাই একসাথে দাড়িয়ে খাবারের সাথে ছবি তোলা, অতঃপর খাবার শুরু। গতবারে খাবার নেয়ার সময় বিশাল আকৃতির কিছু কাঁকড়া নিয়েছিলাম, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার খুব অনুরোধ করেছিল কাঁকড়াগুলি যাতে আমি রান্না করি। কিন্তু কালকে ভোর পর্যন্ত ব্রিজে থাকায় ভুলে গিয়েছিলাম ব্যাপারটি। এখন মনে হল আসলেই একটু কষ্ট করে হলেও আমার অংশগ্রহণ করা উচিৎ ছিল, উপমহাদেশীয় বাদে অন্যান্যরা বেশ ভালই উপভোগ করছে শুধু ভাপে রান্না করা কাঁকড়া। খেতে খেতে আলীকে প্রশ্ন করলাম এটা তো ক্রিসমাসের ভোজ, কিন্তু পার্টি কখন। সে জানালো পার্টির ব্যাপারে সে কিছু জানেনা। আলী আর জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার লিউ হল আমাদের শিপ বিনোদন ক্লাব এর চেয়ারম্যান ও মহা সম্পাদক। আমি বললাম তুমি না জানলে ক্লাব থেকে পদত্যাগ কর তোমরা দুইজন, আজকে বড়দিন তোমরা পার্টি’র আয়োজন করনি এটা বিশাল ব্যর্থতা। লিউ স্মার্ট ছেলে, সাথে সাথে ঘোষণা দিয়ে দিল পার্টি সন্ধ্যা সাতটায়। খাবার শেষে শুরু হল উপহার পর্ব। রিক্রিয়েশন ক্লাব এর তরফ থেকে উপহার কেনা হয়েছিল সবার জন্য, সেগুলি এখন বিলি করা হবে। খ্রিষ্টান নাবিকদের বলা হল তারা যেন আগে উঠায় তাদের উপহার। সবার জন্য একই দামের জিনিষ কেনা হয়েছে, কিন্তু কাউকে দেখে পছন্দ করার সুযোগ দেয়া হলনা, ব্যাগ থেকে একটি একটি করে তুলে নিতে দেয়া হল।

কয়েকজন বলল আমাকে দিয়ে শুরু করতে, ব্যাপারটা বিব্রতকর হয়ে গেল, কারণ যেদিন ওরা এসব কিনে আমাকে দেখাতে নিয়ে এসেছিল, সেদিনই আমার গিফট টি প্রথম দিয়ে দিয়েছিল। খাবার পর্ব শেষ করে ব্রিজে চলে এলাম, দুপুরের মেসেজ পাঠাতে হবে, আবদুল কে ভোজ সভায় আনন্দ করতে দিলাম। ব্রিজে জেরি আর বিশাল দুজনেই আছে, বিশাল খাবার খেয়ে জেরি কে রিলিভ করেছিল, এখন জেরি ফিরে এসেছে। গন্তব্য পর্যন্ত কত দূরত্ব বাকি আছে এবং কটায় পৌঁছব এ দুটি তথ্যই দরকার। জেরি বলার আগেই বিশাল বলে উঠল ১৮০ নট। জানতে চাইলাম নট হবে না নটিক্যাল মাইল, সে লজ্জিত ভাবে বলল নটিক্যাল মাইল হবে, সংক্ষেপে নট বলে ফেলেছে। এখন দুজনকেই প্রশ্ন করলাম নট কি নটিক্যাল মাইলের সংক্ষেপ নাকি, দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে, আমতা আমতা করে বলে ফেলল যে এক ঘণ্টায় এক নটিক্যাল মাইল গেলে এক নট গতি ধরা হয়, কিন্তু নট কি নটিক্যাল মাইলের সংক্ষেপ কিনা দুজনের কেউ জানেনা। আসলেই অনেকের এই ভুল ধারণা হয় যে নটিক্যাল মাইল থেকে নট এসেছে। কিন্তু নট এসেছে নট বা বাংলা গিঁট থেকে। গতি মাপার জন্য যখন কাঠের টুকরা বা লগ ব্যাবহার করা হত, সেই তখন থেকেই নট এসেছে। প্রথমে একটি কাঠের গুড়ি বা লগ জাহাজের সামনে থেকে পানিতে ফেলে দিত, সেটা সামনে থেকে পেছনে ভেসে আসতে যতটা সময় লাগত তা দিয়ে হিসেব কসে জাহাজের গতি বের করা হত। কিন্তু এতে প্রত্যেকবার গতি হিসেব করার জন্য একটি করে লগ লাগত, তাই বিকল্প হিসেবে চিপ-লগ বানানো হল। এতে একটি কাঠের টুকরাই অনেকবার ব্যাবহার করা যাবে। তারা একটি কাঠের টুকরা কে একটি লম্বা রশির মাথায় বেধে দিত, আর রশিটির আরেক প্রান্ত ডেকে বেধে রাখা হত। তখন ঘড়ি বলতে বালু ঘড়ি ব্যাবহার করা হত।

বালু ঘড়ি একবার উল্টালে বালু শেষ হতে ৩০ সেকেন্ড এর মত সময় নিত। নিখুঁত গতি হিসেব করার জন্য একজন বালু ঘড়ি নিয়ে দাড়িয়ে থাকত, আরেকজন রশিটি কে আলতো ভাবে ধরে কাঠের টুকরা টি পানিতে ফেলে দিত। ঘুড়ি উড়াতে যারা খুব অভিজ্ঞ, তারা লাটাই ব্যাবহার করে না ঘুড়ি ছাড়ার সময়, লাটাই কে মাটিতে ফেলে রেখে হাত দিয়ে সুতাটি ধরে রাখে, খুব সুন্দর ভাবে হাত থেকে সুতা ভেসে যেতে থাকে, আবার যখন প্রয়োজন পরে খপ করে ধরে ফেলে সুতা যাওয়া বন্ধ করে দেয়। অনেক সময় খুব ধার মাঞ্জা লাগানো সুতা এরকম করতে গিয়ে হাত কেটে ফেলতে দেখেছি, কিন্তু কৌশলী ঘুড়ি খেলোয়াড়রা হাত দিয়েই ঘুড়িকে খেলানো পছন্দ করে। জাহাজ থেকে লগ পানিতে ফেলার ব্যাপারটিও অনেকটা সেরকম, হাতের ফাঁক দিয়ে রশিকে বেড়িয়ে যতে দিত। আর ঘড়ি ওয়ালা বালির পতন দেখে তাকে জানাতে থাকতো আর কতটুকু বালি আছে। একসময় বালি শেষ হয়ে গেলে বলত স্টপ, আর তখনই রশি খপ করে ধরে ফেলত। এর পর রশি মেপে দেখত ৩০ সেকেন্ড কতটুকু রশি বেড়িয়ে গিয়েছিল। বার বার রশি মাপা একটি ঝামেলার ব্যাপার, তাই তারা নির্দিষ্ট দূরে দূরে একটি করে গিঁট বা নট দিত, রশি হাতের তালুর ফাঁক গলিয়ে বেড়িয়ে যেতে থাকতো, যখনি একটি গিঁট হাতের তালু দিয়ে পার হত সে গুনত এক, দুই, তিন এভাবে। ৩০ সেকেন্ডে যতটি নট পার হত জাহাজের গতিও তত নট, এই ছিল হিসেব। এখন সেই রশিও নেই আর সেই কাঠের গুড়িও নেই কিন্তু নট বেচে আছে। অত্যাধুনিক প্লেন এর গতিও নটে ই বলা হয়। শুধু নট নয় এরকম অনেক শব্দই জাহাজের প্রাচীন নাবিকরা শুরু করেছিল যা এখনও টিকে আছে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করে। ছোট বেলা একটি রম্য গল্প শুনে ছিলাম। এক লোক কে জিগ্যেস করা হয়েছে তার ছেলেরা কি করে, তার উত্তর হল তার এক ছেলে পাইলট, আরেক ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আরেক ছেলে আর্টিস্ট।

তার মানে হল তার এক ছেলে গুদারা নৌকার মাঝি, সে পাইলট। আরেক ছেলে তালা’র মিস্ত্রি সে হল ইঞ্জিনিয়ার, আরেক ছেলে টিনের সুটকেস রঙ করে তাই সে আর্টিস্ট। কিন্তু আসলেই নৌকা চালক থেকেই পাইলট শব্দটির উৎপত্তি এবং সেটি হয়েছে বিমান আবিষ্কার হবার প্রায় চারশো বছর আগে। ১৫ শতকে ফ্রেঞ্চ শব্দ পিলতে থেকে পাইলট এসেছে যা বলতে যে নৌকার হাল ধরত তাকে বুঝাতো। পিলতে শব্দটির উৎপত্তি বলা হয় গ্রীক শব্দ পেডন থেকে এসেছে যার মানে হল দাঁড় বা বৈঠা। কিন্তু আবার বলা হয় এর উৎপত্তি ডাচ পাইল-লোড থেকে এসেছে। পাইল হল খাড়া এবং লোড হল ভারি বস্তু। আগের দিনে বন্দরে ঢোকার সময় একজন ব্যক্তি খাড়া একটি লগি নিয়ে পানি মাপত, সে থেকেই পাইলট এর উৎপত্তি। আগের দিনের ছোট নৌকা কে কক-বোট বলা হত। সেই কক-বোট চালক কে কক্‌সয়েন(coxswain)বলা হত। এখনও লাইফবোট এ যে হাল ধরবে তাকে কক্‌সয়েন বলা হয়। নৌকার হাল যে ধরত তার বসার জন্য পেছনে একটি তক্তা থাকে, তাকে বলা হত কক-পিট, মানে কক্‌সয়েন বসার জায়গা, যেখান থেকে এখন বিমান চালানো হয়। এসব না জানাতে বিশাল খুব বিব্রত বোধ করাতে বললাম আমার এক এমেরিকা প্রবাসী বন্ধু আছে সে পাইলট, তাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম পাইলট আর ককপিট শব্দ দুটি কোত্থেকে এসেছে, সে বলতে পারেনি, সুতরাং তোমার এতে বিব্রত হবার কিছু নেই।

সন্ধ্যায় সাতটায় আমাদের পার্টি শুরু হল, যদিও আমার প্ররোচনায় খুব দ্রুত এটা আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে চীফ অফিসার আর সেকেন্ড কুক বেশ কয়েকটি গেম এর আয়োজন করেছে, সেই গেম এর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও যোগার করেছে। আমি গেম শুরু করে দিয়ে ব্রিজে চলে আসলাম, ভোর ২টা বাজে জাহাজ বহির্নোঙ্গরে পৌঁছবে, কিছু প্রস্তুতির দরকার। ব্রিজে আসতেই আবদুল জানাল ভয়েজ অর্ডার চলে এসেছে, সাথে সাথে প্রয়োজনীয় মেসেজ পাঠানো শুরু হল, ইলেকট্রনিক ইমিগ্রেশন এর আবেদন পাঠিয়ে দেয়া হল, না হলে আমাদের বন্দরের সীমানায় ঢুকতে দেয়া হবে না। এর পর ম্যাপে দাগ দিয়ে নির্দেশ দিয়ে এলাম যেখানে ইঞ্জিন রুম কে নোটিশ দিতে হবে, তার পর যেখানে আমাকে ডাকতে হবে, এবং সেটা রাত বারটার দিকে হবে, যখন আমার জন্য শুরু হবে আরেকটি দিন। তাই আজকের দিনের এখানেই সমাপ্তি, শুভ রাত্রি।
(২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ভাসমান ৮৫ দিন: মঙ্গলবার।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে