আজকের দিন শুরুই হল অনিশ্চয়তা, ব্যস্ততা আর উদ্বেগের সংমিশ্রণে। সমস্ত ইঞ্জিনরুম সেই সকাল ৮টা থেকে ইঞ্জিনরুমে, এর মধ্যে কারোই কোন বিশ্রাম হয় নি। আমার শারীরিক বিশ্রাম হয়েছে কিন্তু মানসিক ক্লান্তি সবার চেয়ে বেশিই হবে, কারণ গুলি গুলো ছোরা হবে আমাকে, সবার টেলিফোন আমাকে রিসিভ করতে হবে, সবাই আমার সাথে কথা বলবে, অন্য কারো সাথে না। উত্তর আমাকেই দিতে হবে। মুভি দেখে কিছুটা সময় কাটানো র চেষ্টা করলাম, তাও ভালো লাগল না।
০২০০: ইঞ্জিনরুমে গেলাম, এরকম পরিস্থিতিতে আমি কখনো ইঞ্জিনরুমে ফোন করিনা, জানি সবাই কাজে ব্যস্ত, শুধু ফোন রিসিভ করার জন্য একজনকে সেই নিচ থেকে উপরে ইঞ্জিন কন্ট্রোল রুমে আসতে হবে, যে আসবে সে একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হবে, তার কাছ থেকে কিছুই জানা যাবেনা। তাকে যদি বলি আমি সেকেন্ড বা চীফ ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে কথা বলতে চাই, সে আবার নীচে যাবে, তাদের কেউ একজন আসবে। এতে যা সময় লাগবে ততক্ষণে আমি ইঞ্জিনরুমে গিয়ে ঘুরে আসতে পারব। গিয়ে দাড়িয়ে রইলাম, শুধু তাদের ব্যস্ততা দেখা ছাড়া আমার কিছুই করার নেই। চীফ ইঞ্জিনিয়ার কে একটু সরে আসতে দেখে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। জানতে চাইলাম কি অবস্থা। শেষ কথা অনুযায়ী রাত ২টায় কাজ শেষ হবার কথা। সে জানালো একটু সময় লাগবে, আরও এক ঘণ্টা। ক্যাবিনে চলে আসলাম, এসে আবার অপেক্ষা।
০৩০০: চীফ ইঞ্জিনিয়ার ফোন করল, স্যার আরও ঘণ্টা খানেক লাগবে। বললাম অসুবিধা নেই, তুমি নিরাপদে কাজ কর। আমি জেগে আছি। যখন শেষ হবে আমাকে ফোন করবে। আমাদের তিনটা মানে সিঙ্গাপুরে বিকেল পাঁচটা। আমাকে টেকনিক্যাল ম্যানেজার কে ফোন করে জানাতে হবে। সেও উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করছে, জাহাজের ঠিকঠাক মত চলার গ্যারান্টি দাতা সেই। তাকেই জবাবদিহি করতে হবে অফিসে। শুয়ে শুয়ে টিভি দেখে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করা। কোন কাজেই মন বসছে না, এ সমস্যা হয়ত কয়েক ঘণ্টাতে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু কালকে এ নিয়ে কি কাহিনী শুরু হবে সেটা নিয়ে আমি বিরক্ত এবং চিন্তিত। সম্ভাব্য সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে আগেই মেইল লিখে রাখলাম। কখন কি হয়েছে, কখন কোন পরিস্থিতিতে আমি কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি সে সব সময়ের সাথে লিখে রাখলাম।
০৪৩০: চীফ ইঞ্জিনিয়ার ফোন করল, আওয়াজ শুনেই বুঝে গেলাম খবর ভালো না। তারা কাজ শেষ করেছে, কিন্তু ইঞ্জিন ঠাণ্ডা করার জন্য যে পানি সরবরাহ করে তা লিক করছে ব্যাপক ভাবে। তারা কাজ শেষ করে তার পর পানি ভরেছে দেখার জন্য, কিন্তু সাথে সাথেই চারিদিকে পানি বেড়িয়ে আসছে। চীফ ইঞ্জিনিয়ার জানালো এখন আবার খুলবে, খুব সম্ভব পানিরোধক যে সিল থাকে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটা পরিবর্তন করতে হবে। আমিও সকাল থেকে জেগে আছি, এদিকে ইঞ্জিন ঠিক হলে আমাকে পরীক্ষা করতে হবে। ইঞ্জিন পরীক্ষার জন্য আমাদের এঙ্কর তুলতে হবে, তারপর এই সীমিত জায়গায় যতটা পারা যায় ইঞ্জিন চালিয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে সব ঠিক আছে, তার পরে বিশ্রাম নিতে পারবো। চীফ ইঞ্জিনিয়ার জানালো আরও ২-৩ ঘণ্টা। আমি ব্রিজে গিয়ে নোট লিখে রাখলাম, যদি টেকনিক্যাল ম্যানেজার ফোন করে, তাকে বলতে যে কুলিং-ওয়াটার লিক করছে, সুতরাং আবার খুলে সিল পরিবর্তন করতে হবে, ৭টার মত বাজবে।
০৭০০: সাড়ে সাতটার এলার্ম সেট করে এর পর দিলাম ঘুম। এলার্মে না, এমনি ঘুম ভেঙে গেল, পাশে রাখা মোবাইলে সময় দেখলাম সাতটা। মনে করতে পারছিলাম না আমি ঘুমিয়েছি কি না। মনে হল জেগেই ছিলাম, কিন্তু আসলে স্বপ্নের মাঝে জেগে ছিলাম। শুয়ে শুয়েই ফোন করলাম, আবদুল জানাল সুপার ফোন করেছিল, সে ইঞ্জিন রুমে থেকে খবর নিয়ে জানিয়েছে যে আরও ঘণ্টা খানেক লাগবে। ওকে বললাম ঠিক হবার সাথে সাথে যাতে আমাকে ডাকা হয় আর সাথে এঙ্কর স্টেশন ডাকা হয়। জাহাজের বাঁধাবাঁধির কাজ, বা বাধন খোলার কাজ বা এঙ্কর উঠা নামার কাজকে আমরা বলি স্টেশন। আমরা ওয়াকিটকি বা পাবলিক এড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা দেই ‘স্টেশন ফরোয়ার্ড এন্ড আফট’ তার মানে হল সমস্ত ডেক এর ক্রুরা সামনে আর পেছনে দুই টিম হিসেবে ভাগ হয়ে চলে যাবে। যদি ঘোষণা দেয়া হয় এঙ্কর স্টেশন, তাহলে শুধু চীফ অফিসার, সারেং আর একজন খালাসি সামনে চলে যাবে। ইঞ্জিন প্রস্তুত হলেই আমাকে এঙ্কর তুলে ইঞ্জিন চালিয়ে দেখতে হবে, এঙ্কর না তুলে ইঞ্জিন চালালে এঙ্কর ছিরে জাহাজ বেড়িয়ে যাবে, গাড়ির মত আমাদের ক্লাচ নেই যে গিয়ার নিউট্রাল রেখে গাড়ির ইঞ্জিন চালালাম। সামনে এঙ্কর তোলার জন্য যেতেও লোকজনের সময় লাগবে তাই ব্রিজে বলে রাখলাম আমাকে ডাকার সাথে সাথেই যাতে তাদের ও সামনে পাঠানো হয়। এই বলে চোখ বুজতেই আবার ঘুম।
০৮৫০: ঘুম ভাঙল থার্ড অফিসারের ফোনে। সাড়ে সাতটায় আমার এলার্ম বেজেছিল, কিন্তু এতই ঘুমে ছিলাম যে এলার্ম আমাকে জাগাতে পারেনি। থার্ড অফিসার জানাল যে সুপার ফোন করেছিল, সে চীফ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা বলতে চায়। থার্ড অফিসার ‘বিশাল’ ইঞ্জিন রুমে ফোন করেছে, কিন্তু চীফ ইঞ্জিনিয়ার বলে দিয়েছে সে আসতে পারবে না, ব্যস্ত। তারপর সুপার আবার ফোন করেছে, বিশাল তাকে এই সংবাদ দিয়েছে, কিন্তু সুপার নাছোড়বান্দা, সে এখন চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর ক্যাপ্টেন দুজনের সাথেই কথা বলতে চায়। বিশাল কে বললাম, আবার ফোন করলে বলবে যে ক্যাপ্টেন ইঞ্জিন রুমে গিয়েছে, সে এসে তাকে পরিস্থিতি জানাবে। আমি রওনা হলাম ইঞ্জিন রুমে। সুপার কে দোষ দেয়ার কিছু নেই, তাকে বলা হয়েছিল প্রথম ভোর ২টা বাজে শেষ হবে, এখন সেটা সকাল ৯টা, স্বাভাবিক ভাবে সে উদ্বিগ্ন হবে। এছাড়া সিঙ্গাপুরে এখন রাত ১১টা, সে বেচারাও ঘুমাতে পারছে না। আবার চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ও করার কিছু নেই, সেও সেই তখন থেকে লেগে আছে, এর মধ্যে ১০ তলা উপরে এসে ফোন রিসিভ করার মত মানসিকতা থাকেনা। কিন্তু আমি এই সুপারকে চিনি, সে ফোন করতেই থাকবে প্রতি ১০ মিনিটে। ইঞ্জিন রুমে গিয়ে দেখলাম সবাই এখনও আছে। এটা ২৫তম ঘণ্টা চলছে, কেউ কোন বিশ্রাম নিয়েছে বলে মনে হয় না। চীফ ইঞ্জিনিয়ার কে ডেকে বললাম সুপার দুজনের সাথেই কথা বলতে চায়, এবং চল কথা বলে আসি নাহলে সে আরও ডিস্টার্ব করবে। চীফ ইঞ্জিনিয়ার কে নিয়ে উপরে এলাম, ফোন করলাম সুপারকে।
কিছুই বলার নেই, যান্ত্রিক ব্যাপার, সমস্যা হতেই পারে, এতে কারো পক্ষে নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব না, কখন শেষ হবে। সমস্যা হচ্ছিল দুইটি নাট-বোল্ট নিয়ে, খুলছিল না, এতেই সময় নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে জোর জবরদস্তি করার উপায় নেই। খুবই নিখুঁত ভাবে খুলতে হবে, না হলে যদি নাট-বোল্ট সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, এর সংশোধন আরও অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সুপার ও একজন ইঞ্জিনিয়ার, সেও সবই জানে, কিন্তু সে একটু অস্থিরতায় ভোগা লোক। তাকে জানালাম যে ইঞ্জিন প্রস্তুত হবার সাথে সাথেই তাকে ফোন করে জানবো, সেটা যত রাতই হোক, সিঙ্গাপুরে তখন রাত বারটা। চীফ ইঞ্জিনিয়ার বলে দিল, খুলতেই সমস্যা হয়, কিন্তু লাগাতে কোন সমস্যা না, সুতরাং আরও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। সে এও বলে দিল যে রাত চারটায় সব হয়ে গিয়েছিল কিন্তু সে পানি লিকের ব্যাপারটা আশঙ্কা করে নি, চেষ্টা করেছে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার জন্য, সময় বাচাতে গিয়ে এখন অতিরিক্ত সময় লাগলো। সুপারকে ঘুমে পাঠিয়ে চীফ ইঞ্জিনিয়ার নীচে চলে গেল, আর আমি অপেক্ষায়। গত ২৪ ঘণ্টায় আমারও ঘুম হয়েছে ঘণ্টা পাঁচেক। এদিকে ইঞ্জিন প্রস্তুত হবার পর পাইলট নিয়ে একদম জেটি পর্যন্ত সব শেষ করতে ১২ ঘণ্টা লাগবে এবং ততক্ষণ আমার নিস্তার নেই।
১১০০: গেলাম ইঞ্জিন রুমে। আমি ইঞ্জিনিয়ার নই, কিন্তু তাকিয়ে অনুমান করে নিচ্ছি কি কি বাকি আছে। একটি ইউনিট মানে সিলিন্ডার খোলা হয়েছে, পাশের সিলিন্ডার গুলি অক্ষত আছে। আমি পাশের সিলিন্ডারগুলির দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি ও গুলোতে কি কি লাগানো আছে। অন্য সিলিন্ডার গুলিতে যা যা লাগানো আছে, মানে যে সব পাইপ লাগানো আছে, এটাতেও সেগুলি লাগবে। মনে মনে হিসাব করি আর কতক্ষণ লাগতে পারবে। আমাদের পাইলট বিকেল ২:৩০ এ। এখান থেকে নোঙর তুলে আরও ১০ কিমি যেতে হবে, অন্তত ৪০ মিনিট লাগবে। নোঙর তুলতে ২০ মিনিট, সুতরাং অন্তত ১:৩০ এর মধ্যে আমাকে ইঞ্জিন পেতে হবে। চীফ ইঞ্জিনিয়ার কে ইশারা করে জানতে চাইলাম আর কতক্ষণ, সে জানাল আরও একঘণ্টা। কিন্তু আমি জানি সেটা সম্ভব না। চীফ ইঞ্জিনিয়ার বেচারা পাগলের মত দৌড়াদৌড়ি করছে। সে আর সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার বাদে সবাই খুব অল্পবয়স্ক এবং অনভিজ্ঞ। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম, কিছুই করার নেই, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা, কিন্তু উপরেও যেতে পারছিনা, অস্থিরতায় ভুগছি। সাড়ে ১১টায় উপরে চলে আসলাম, চীফ অফিসার কে বলে রাখলাম যে তার টিম যাতে প্রস্তুত থাকে নোঙর তোলার জন্য। চলে গেলাম লাঞ্চ করতে, সকালে কিছুই খাওয়া হয় নি, এমনকি কফিও না।
১২১৫: আবার ইঞ্জিন রুমে গেলাম, কারো চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। ক্লান্তির শেষ পর্যায়ে সবাই। তারপরেও চীফ ইঞ্জিনিয়ার একাই মনে হয় ৩ জনের কাজ করছে। আমি এখানে রোগীর অভিভাবকের মত, অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছি শল্যচিকিৎসকদের দিকে। সমস্যা এখন আরও ভয়াবহ, যদি আমরা পাইলট সময়মত নিতে না পারি, তাহলে জাহাজ ফেঁসে যাবে। আমাদের আবার ইউএস কোস্টগার্ড এর পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। এই পরীক্ষা বা ইন্সপেকশন দু বছরে একবার হয়, আমাদের মাত্র তিন মাস আগে হয়ে গেছে এবং সেই ইন্সপেকশনে কোন অবসারভেশন দেয়া হয় নি, একদম নিখুঁত জাহাজ হিসেবে সনদ দেয়া হয়েছে। এখন এরকম সমস্যা হলে তারা তাদের সনদ আবার পুনঃমুল্যায়ন করবে নিশ্চিত। এবং এবার যখন আসবে তখন হিংস্র পরীক্ষকের মত আসবে। চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে ইশারায় জানালাম হাতে মাত্র ১ ঘণ্টা আছে। এর মধ্যে না হলে সম্ভব না। এক ঘণ্টা মানে সোয়া একটায় ইঞ্জিন এর কাজ তারা শেষ করে ১৫ মিনিট এর মত সব কিছু চেক করে স্টার্ট করবে, দেড়টায় নোঙর উঠান শুরু না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এত শ্রম, এতো ক্লান্তি সব বিফল। চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে বলে আবার উপরে চলে আসলাম।
১৩০০: কোন খবর নেই ইঞ্জিন রুম থেকে। দেড়টা বাজে শেষ না হলে আসলেই সম্ভব না। আবার নীচে গেলাম। অবস্থা দেখে বুঝলাম সম্ভব হচ্ছে না। চীফ ইঞ্জিনিয়ার কে বললাম ৩০ মিনিটের মধ্যে না হলে কি কি হতে পারে। কিন্তু বেচারা কি করবে, এত খুঁটি নাটি জিনিষ, সব তো লাগাতে হবে। এমনিতে সে যা করছে অতিমানবিক। ১৩২৫ এ তাকে ডাকলাম, বললাম কিছু কথা বলব। তখন তারা কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে, পানির লাইন খুলে দিয়েছে ভরে দেখার জন্য। চীফ ইঞ্জিনিয়ার আসলে তাকে নিয়ে কন্ট্রোল রুমে এলাম, বললাম ইঞ্জিন গুছাতে থাকো আর এর মধ্যে আমাকে আরেকটি জেনারেটর দাও। আমি জানি একটি জেনারেটর চলছে, কিন্তু আরেকটি জেনারেটর ছাড়া নোঙর তোলা যাবেনা। ইঞ্জিনরুম থেকে ব্রিজে ফোন করে বললাম, চীফ অফিসারকে এঙ্কর-স্টেশনে পাঠাতে। চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে বললাম এখন আমার কাছে ১০মিনিট ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি এঙ্কর অর্ধেকের বেশী তুলে রাখতে চাই, বাকিটা ইঞ্জিন প্রস্তুত হলে তুলব। চীফ ইঞ্জিনিয়ার বলল স্যার আপনি ব্রিজে যান, ব্রিজে যেতে যেতে নোঙর তোলার পাওয়ার এসে যাবে। ব্রিজে যাবার মুহূর্তে জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ারের সাথে দেখা, তাকে বললাম তুমি একটা ওয়াকিটকি চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে নীচে দিয়ে আসো, সে যাতে সর্বক্ষণ ওয়াকিটকিতে থাকে, আমি ফোন করতে পারবো না। আমি ব্রিজে যেতেই বলল যে সামনে পাওয়ার দেয়া হয়ে গেছে। চীফ অফিসারকে বললাম নোঙর তোলা শুরু করতে।
১৩৪৫: চীফ ইঞ্জিনিয়ার ওয়াকিটকিতে জানাল পানি ভরছে, কিন্তু সামান্য লিক করছে কিন্তু সেটা সহনীয়, এ অবস্থায় চালিয়ে নেয়া যাবে, আরও বলল এখন তাপমাত্রা কম, তাপমাত্রা বাড়লে এই লিক বন্ধও হয়ে যেতে পারে। সাথে সাথে ফোন আসল যে ইঞ্জিন ব্লো-থ্রু করবে। ব্লো-থ্রু হল জালানি না দিয়ে শুধু বাতাসের চাপে ইঞ্জিন কে ঘুরানো। ব্লো থ্রু হয়ে গেল ঠিক ঠাক। চীফ ইঞ্জিনিয়ার কে জিগ্যেস করলাম ইঞ্জিন দিতে আর কতক্ষণ, সে জানালো ২-৩ মিনিটের মধ্যে ইঞ্জিন দিতে পারবে। এদিকে আমার এঙ্কর অর্ধেক তুলে ফেলে অপেক্ষা করছি।
১৩৫০: ইঞ্জিন রুম থেকে জানালো আমি ইঞ্জিন ট্রাই করতে পারি। ইঞ্জিন চালালাম, সাথে সাথে স্টার্ট কোন ঝামেলা ছাড়া। আবার বন্ধ করে রিভার্স বা পেছনের দিকে ঘুরালাম, তাও নিখুঁত। আমার মাথা ঠাণ্ডা হতে শুরু করল। এর মধ্যে পাইলট কল করে জানাল তারা ১৪২০ এ চলে আসবে, আমরা যাতে প্রস্তুত থাকি। চীফ অফিসারকে বাকি নোঙর উঠানো শুরু করতে বললাম। ১৩৫৮ তে আমাদের নোঙর উঠে গেল, ইঞ্জিনও চলতে শুরু করল।
আধুনিক ইঞ্জিন এর গতি কম্পিউটার দারা নিয়ন্ত্রিত থাকে, ইচ্ছে করলেই এক্সিলেটর চাপ দিয়ে বাড়িয়ে দেয়া যায় না। ইঞ্জিনের উপর লোড হিসেব করে আস্তে আস্তে বাড়বে। কিন্তু এটা কে এড়ানো যায়, চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে বললাম আপাতত একে এড়িয়ে যাও, মানে বাই-পাস কর, আমার স্পীড দরকার। গতকাল পাইলট মিস হয়েছে, এখন দেরী করলে পাইলট সন্দেহ করবে যে আসলে আমাদের সমস্যা আছে। লোড-প্রোগ্রাম বাইপাস করে ছুটলাম পাইলট যেখানে তুলব সেখানে। র্যাডারে পাইলট বোট এর দিকে নজর রাখছি, আর এদিকে আমি গুনছি ৮ কিমি বাকি, ৭ কিমি বাকি। ভাগ্য কিছুটা সহায়ক, পাইলট বোট কিছুটা ধীরে আগাচ্ছে। চিফ ইঞ্জিনিয়ার কে বললাম কয়েক মিনিটের জন্য ব্রিজে আসতে, সুপার কে ফোনে জানাতে হবে। পাইলট এর সামনে এসব আলাপ করা যাবে না। চীফ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিজে আসলে সুপারকে ফোন করলাম, তখন সিংগাপুর সময় ভোর সাড়ে চারটা। তাকে জানালাম সব কিছু শেষ, এখন পাইলট নিয়ে রওনা হচ্ছি। সেও বাকি রাত টুকু ভালো ঘুমাবে। সুপারিন্টেনডেন্ট আরও কিছু বিস্তারিত জানতে চাচ্ছিল, কিন্তু চীফ ইঞ্জিনিয়ার বলে দিল যে বেশিক্ষণ কথা বলা যাবেনা, আমার কাপড়ের যা অবস্থা, এই অবস্থায় পাইলট দেখলে বুঝে নেবে যে আমরা কোন মহা সমস্যা অতিক্রম করছি। ফোন রেখে চীফ ইঞ্জিনিয়ার চলে গেল আবার ইঞ্জিন রুমে, আর তখন ১৪৩৬, পাইলট জাহাজে উঠল। পাইলট আসার পর চীফ অফিসারকে ব্রিজে ডাকলাম দু ঘণ্টা আমাকে রিলিভ করার জন্য। চীফ অফিসার আসল তিনটা বাজে, পাইলট কে বুঝিয়ে গেলাম যে দু ঘণ্টার জন্য চীফ অফিসার আমার পরিবর্তে থাকবে, আমার বিশ্রাম নিতে হবে কারণ এর পরে একটানা আবার চার পাঁচ ঘণ্টা আমি থাকব।
চীফ অফিসার কে রেখে ঘুমাতে আসলেও ঘুম আসল না তেমন। ব্রিজে বলে রেখেছিলাম আমাকে ৫:১০ এ ফোন করে জাগাতে, কিন্তু আমি নিজেই পাঁচটা বাজে ব্রিজে চলে গেলাম। চীফ অফিসারকে পাঠিয়ে দিলাম বিশ্রাম নিতে। আমি যাবার সাথে সাথেই সাগর থেকে নদীতে ঢুকল জাহাজ, সাথে উঠে এলো দ্বিতীয় পাইলট এবং তিনি মহিলা পাইলট। একদম ছোট খাট হালকা পাতলা ভদ্রমহিলা, ব্রিজে ঢুকেই হাত বাড়াল হ্যান্ডশেক করার জন্য, ‘হাউ আর ইউ ক্যাপ্টেন, আই এম ক্রিস্টিন’। আমি চিরাচরিত অভ্যাস বশত বললাম ‘আই এম ফাইন স্যার’। পাইলট মেয়ে হতে পারে ভুলে গিয়েছিলাম। সাথে সাথে সংশোধন করলাম ‘ম্যাম’। দু পাইলট মিলিয়ে জাহাজ নিয়ে রওনা হল। ডিনারের জন্য জিগ্যেস করাতে আগের পাইলট মানে পুরুষ পাইলট বলল সে কিছুই খাবেনা। মহিলা পাইলট জানাল সেও কিছু খাবেনা, সে সালাদ প্যাক করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তার কথার মধ্যে একটু দ্বিধা দ্বন্দ্ব দেখে আমি আবারো অনুরোধ করলাম। শেষে বলল সে সুপ খেতে পারে। ফোন করে সেকেন্ড কুক কে বললাম সুপ নিয়ে আসতে। সুপ নিয়ে আসার পর সে সুপ নিয়ে তার চেয়ারে বসে চুমুক দেয়ার সাথে সাথে আবার চেয়ার থেকে নেমে এসে সুপ রেখে দিল, আমি বুঝে গেলাম আজকের সুপ চীফ কুক বানিয়েছে এবং সেটা ভালো হয় নি। সে ও আমাকে কিছু বলল না সুপের ব্যাপারে, আমিও এমন ভাব করলাম যে আমি দেখিনি যে সে সুপ রেখে দিয়েছে। এরপর বেচারা তার ব্যাগ খুলে ঘাস পাতা খাওয়া শুরু করল। এর মাঝ খানে আমি ১০ মিনিটের জন্য নীচে নেমে খেয়ে আসলাম।
দুজনেই জাহাজ বেশ দ্রুত গতিতে চালিয়ে নিলো, সাড়ে নটায় জেটির কাছে পৌঁছানোর কথা থাকলেও সাড়ে আটটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। অন্যান্য সময় দেখি প্রথম যে পাইলট উঠে, শেষ বাধা টা সেই বাধে। আজকে এই মহিলা পাইলটই বাধার কাজ শেষ করবে মনে হল। বাধার সময় ক্যাপ্টেন আর পাইলট কে ব্রিজের বাইরে দাড়াতে হয়। জাহাজ বাধার সময় পাইলট কে জিগ্যেস করলাম সে জাহাজে সেইল করেছে কিনা। সে খুব গর্বের সাথে জানাল যে সে ১৩ বছর সেইল করেছে এবং ১৩ বছর পাইলট। তারপর আবার যোগ করল যে সে এরকম বড় ট্যাংকারে বা ভিএলসিসি তেই অধিকাংশ চাকুরী করেছে। আমিও ও বললাম আসলে আমিও বড় জাহাজে ভালোবাসি এবং ভিএলসিসি তেই বেশিরভাগ কাটিয়েছি। সে সাথে সাথে প্রশ্ন করল তোমার সবচেয়ে বড় জাহাজ কত ছিল। আমি বললাম ৫৫৫০০০, সে একটু আহত ভাবে জানাল তার সর্বোচ্চ জাহাজটি ২৭৫,০০০ টনের ছিল, হয়তো তার জাহাজটি অপেক্ষাকৃত ছোট হওয়াতেই সে আর জাহাজের গল্পে এগোল না। পৌনে দশটাতেই আমাদের বাধা বাধির কাজ শেষ। বাধা শেষ হতে হতেই এজেন্ট হাযির, সাথে সার্ভেয়র, টার্মিনাল এর লোকজন। এদের সাথে আমার কিছু প্রথাগত কাজ থাকে, সেগুলি শেষ করে আবার ব্রিজে চীফ ইঞ্জিনিয়ার কে নিয়ে। আগেরবার সুপারকে শুধু জানিয়েছি যে সব ঠিকঠাক, বিস্তারিত বলার কোন সময় ছিলনা। সে তখনই বলেছিল যাতে বার্থিং এর পর তাকে ফোন করি। সুপার কে ফোন করে বিস্তারিত জানানো হল, এও বলে দিলাম লিখিত রিপোর্ট পাঠাতে দেরী হবে, সবাই ক্লান্ত। এর পরে আমার সুপারবয় কে ফোন করলাম মানে ভিডিও কল। বেশিক্ষণ তার সাথে কথা বলা সম্ভব হল না, এমনি ক্লান্ত তাছাড়া কার্গো শুরু হবে, এসব মেসেজ পাঠিয়ে ঘুমবো। সারাদিনের অনবদ্য দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, ব্যস্ততার পর এই কয়েক মিনিট ভিডিও কল সব ক্লান্তি দূর করে দিল। সব ভাল যার শেষ ভাল, হে দিনটির শেষ আসলেই ভাল হল। শুভ রাত্রি। (২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ভাসমান ৮২ দিন: শনিবার)।