নাবিকের সমুদ্র কথন- ৭৭ : ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
600

আবার ফিরে যাওয়া সেই পুরনো অভ্যাসে, রাত বারটায় শুরু হওয়া দিন। গত রাতে সাড়ে দশটাতেই নোঙর তুলে রওনা হয়েছিলাম অন্য জাহাজটির উদ্দেশ্যে। গিয়ে সেই অপেক্ষার পালা। পাইলট আসল সাড়ে বারোটায়, অতঃপর বেলুন বাঁধাবাঁধি শেষ করে শুরু হল আমাদের যুগলবন্দী। সমান্তরাল রেল লাইনের মত বইতে বইতে একসময় একে অপরকে আলিঙ্গন করে আপন করে নেয়া। তার পরেও এই আলিঙ্গনের বাধনে আমরা বিশ্বাসী নই, তাই রশি দিয়ে বেধে ফেলা হল দুজনকে একসাথে।

রাত দশটায় ব্রিজে ক্যাপ্টেনের কাজ শুরু, এর পর বাধা শেষ হল ভোর সাড়ে পাঁচটায়। উপরের কাজ সেরে এলাম নীচে কন্ট্রোল রুমে। আমার চেয়েও আমি চিন্তিত থাকি চীফ অফিসারের জন্য, এধরনের লাইটারিং এ চীফ অফিসারের উপর ঝড়টা যায় বেশী। চীফ অফিসার শক্ত ছেলে, কান্না কাটি করেনা, এ ব্যাপারটা আমার ভাল লাগে। কান্নাকাটি মানে হল সব সময় হা হুতাশ করা। অনেকেই আছে কাজে কর্মে ভালো, কাজও করে সারাদিন কিন্তু প্রচুর অসন্তোষের সাথে, সর্বক্ষণ অভিযোগ। এ কাজ পারেনা, এ রঙ করতে পারে না, এ কথা শুনেনা, কোম্পানি ভালো না, ইনক্রিমেন্ট দেয়নি এ বছর এরকম নানাবিধ ব্যাপারে তারা সর্বদা অসন্তুষ্ট থাকে আর তার এই অসন্তোষ প্রকাশের একমাত্র জায়গা হিসেবে ক্যাপ্টেনকে বেছে নেয়। মাইকেল এ ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। সে জানাল অসুবিধা নেই, আমি বিশ্রাম নিয়ে নেব মাঝ খানে। রাতেই আরেক জনের সাথে যুগলবন্দী খেলতে যাব। বললাম যত তাড়াতাড়ি পারো কার্গো শেষ করে দাও, আমাদের রাত এগারোটার মধ্যে প্রস্তুত থাকতে হবে পরবর্তী জাহাজের জন্য।

এদিকে সারারাত জেগে চরম খুদা। সকাল মাত্র ছটা বাজে, কিচেনে উকি দিলাম। ইসমাইল কফি বানাচ্ছে, আমাকে দেখেই বলল আপনার জন্যেও বানাই, একটু অপেক্ষা করেন। সেকেন্ড কুক এবং চীফ কুক দুজনেই হাযির। সেকেন্ড কুক মহা উদ্যমে তার প্রাতরাশ তৈরি করছে। ডিম স্ক্রাম্বল করে ফেলেছে, একটি বড় প্যানে অনেক পেয়াজ মরিচ আর টম্যাটো কশানো হচ্ছে।

জানতে চাইলাম মেন্যু কি, ইশারা দিয়ে দেখাল যে সে আমার একটি প্রিয় জিনিষ তৈরি করছে। জিনিষটা আমাদের বেকারির প্যাটিস এর মত, কিন্তু সাইজে অনেক বড়। ভেতরে কিমা না দিয়ে সে আমার উপদেশে সিঙ্গারার ভেতরে যেরকম ভাজি দেয়া, সেরকম একটি জিনিষ সবজি দিয়ে বানিয়ে দেয়। তাকে বলেছি এগুলি বানাও বেশ ভাল কিন্তু একটু ঝাল দিতে হবে। এখন সে মহা উদ্যমে এসব নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায়। জানতে চাইলাম কতক্ষণ লাগবে তৈরি হতে। সে বলল ১৫ মিনিট। এদিকে ইসমাইল তার কফি তৈরি করে ফেলেছে। আমি কফি নিয়ে কন্ট্রোল রুমে আসলাম, কফি আধা শেষ না হতেই সেকেন্ড কুক এসে হাযির, তৈরি হয়ে গেছে। সাথে টিনজাত সার্ডিন মাছ ও পেয়াজ মরিচ দিয়ে বেশ সুন্দর ভুনা করেছে। সকালে নাস্তা হয়ে গেল দুপুরের লাঞ্চের মত। নাস্তা করে আবদুল কে বলে আসলাম কার্গো শুরু হলে যাতে মেইল করে দেয়। এসে দিলাম ঘুম একটানা সাড়ে এগারটা।

গত কাল পরের লাইটারিং জাহাজটিকে জানিয়ে ছিলাম আমরা আজকে সন্ধ্যা ৬টায় প্রস্তুত থাকব। তখনই জানতাম এটা সম্ভব না, কিন্তু তারপরেও এটাই নিয়ম, ব্যথা একটু আস্তে আস্তে দিতে হয়। হটাত জোরে ঘুষি মারলে ব্যথা লাগে বেশী, প্রথমে হালকা পাতলা কয়েকটা দেয়ার পর একটা জোরে দিলে অনেকটা অভ্যাস হয়ে যায়। তেমনি আমরা অনেক সময় জানি যে সকাল আটটায় পৌছাতে পারবো না, রাত ১২ টা বেজে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রথমেই আমাদের সময় এক লাফে রাত বারটা বানাই না, প্রথম মেইলে একটু বলি যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য আসতে দেরী হবে, ৮টার বদলে নূতন সময় বিকেল ২টা। পরের মেসেজে জানাই এখনো আবহাওয়ার উন্নতি হয় নি, আসবো সন্ধ্যা ৮টায়।

একদম শেষ মেইলে জানিয়ে দেই লাস্ট ফাইনাল রাত বারটা। তাই ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ করতে গেলাম সেটা হল পরের জাহাজ কে জানানো যে আমরা রাত বারটার ১ মিনিট আগে আসবো, কারণ সেটাই আমাদের মেয়াদ উত্তীর্ণের সময়। এ খবর আমাদের পরবর্তী চার্টারারকে জানিয়ে লাঞ্চ করতে গেলাম। ৬ টা বাজে খেয়ে ঘুমিয়েছি, তাই তেমন খুদে নেই, কিন্তু লাঞ্চ দেখে করতে হল। চীফ কুক আস্ত স্যামন মাছ রান্না করছে। সে জানে আমি ঘুম থেকে হয়তো পরে উঠবো। মোটামুটি একটি প্রমাণ সাইজের স্যামনের অর্ধেক সে আমার প্লেটে রেখে দিয়েছে। সাথে হাঁসের মাংস ভুনা। সেকেন্ড কুক কে ডেকে মাছ ফেরত পাঠালাম কারণ এক কেজি মাছ আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব না সেটা যতই প্রিয় হোক, বললাম ছোট একটি টুকরা দেয়ার জন্য। চীফ কুক কাছেই দাড়িয়ে ছিল, একটু হাসি দিয়ে বলল মাছটা ভালো ছিল, একদম টাটকা। বললাম টাটকা বলেই বেশী খেতে হয় না, তাহলে আমি মোটকা হয়ে যাব। লাঞ্চ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে ঘুম ভেঙে গেল। নীচে গেলাম খবর নিতে কতক্ষণ লাগবে কার্গো শেষ হতে। সকালে বলেছিল রাত নটার দিকে শেষ হবে। নীচে গিয়ে শুনলাম আটটার দিকেই শেষ করতে পারবে। যাক তাহলে আমরা বেশ এগিয়ে থাকব। আটটার দিকে শেষ হলে সাড়ে নটার দিকে আমরা বাধন খুলে রওনা হতে পারব, তারপর আরও ঘণ্টা খানেক বেলুন খোলা, সাড়ে দশটা বাজবে, আর একঘণ্টার মধ্যে পরিবর্তী জাহাজের কাছা কাছি পৌঁছে আমাদের প্রস্তুতি জানিয়ে দিয়ে পারব।

এরমধ্যে এজেন্ট জানাল আমাদের বার্থিং ২৫ তারিখে, এতো ব্যাস্ততার মধ্যে এটা একটি ভালো সংবাদ। ২৫ তারিখ বার্থিং হলে আমরা একটু হাফ ছেড়ে বাঁচবো, প্রায় এক সপ্তাহ এঙ্করে বসে থাকব, ধরিব মৎস্য খাইব সুখে। এই এঙ্করে বসে থাকাটা যারা জাহাজ ভাড়া করছে বা আমাদের কোম্পানির জন্যেও তেমন সুখকর ব্যাপার না, দেরী মানে প্রত্যেকদিন জাহাজের ভাড়া গোনা, বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর মত, কিন্তু আমাদের জন্য তা স্বস্তি দায়ক। গ্রামের একটি প্রচলিত কথা আছে, কুকুর নাকি সব সময় দোয়া করে যে তার মনিব ধনে মানে উন্নত হোক, তাতে বাসায় ভালো রান্না হবে, প্রচুর হাড় গোর উচ্ছিষ্ট হবে আর আমি পেট ভরে খেতে পারব। আর বিড়াল নাকি সব সময় প্রার্থনা করে যে হে আল্লাহ আমার মনিব কে অন্ধ করে দাও, তাতে আমি লুকিয়ে তার থালা থেকে মাছটা নিয়ে নিলেও সে টের পাবেনা। আমরা অনেকটা সেই বেরালের মত। আমরা দোয়া করি জাহাজ নোঙরে বসে থাকুক, জেটি খালি না পাক। কিছু করার নেই, লাইটারিং করলে এটাই বাস্তবতা, শুধু আমরা না, সবাই দোয়া করে কয়েকদিনের এঙ্করের এবং সৃষ্টিকর্তা মনে হয় দোয়া কিছুটা কবুলও করে, তাই দেখা যায় একটি লাইটারের পরে স্বয়ংক্রিয় ভাবে কয়েকদিন এঙ্কর পাওয়া যায়। যা হোক দাতে দাঁত কামড়ে আজকের লাইটারিং টা শেষ করতে হবে। গতকাল রাত থেকেই আমাদের বিরতিহীন কাজ চলছে। আজকেও হয়তো সকাল ৪ টার দিকে বাঁধাবাঁধি শেষ হবে। তার পর ১২ ঘণ্টার মত লোডিং, অতঃপর অনেক অপেক্ষার নোঙর।

এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে ঘামাতে পরিকল্পনা করছি, কটার সময় কি হতে পারে, কখন পরবর্তী জাহাজের লোডিং এ যাব, কয়টায় শেষ, ইত্যাদি। এমন সময় আরেক মেইল আসলো এজেন্ট থেকে যে আমাদের আজকের রাতের লাইটারিং বাতিল। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে নোঙরে। ঘন কুয়াশা, সাগরে অত বেশী না তবে উপকুল এলাকায় অনেক বেশী। সার্ভেয়ার এর হেলিকপ্টার উড়তে পারবে না কুয়াশার জন্য। এদিকে আমাদের বার্থিং ২৫ তারিখের আগে না, তাই চার্টারারের অত তাড়াহুড়া নেই। আবহাওয়া পরিষ্কার হলে তারা হেলিকপ্টার পাঠাবে, পরে লাইটার হবে। খবর হিসেবে খারাপ না, লোক জনের একটু বিশ্রাম মিলবে।

রাত আটটা বাজে কাটায় কাটায় কার্গো শেষ হল। এর পর শুরু হল ভাগ দৌড়। আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে, রাত ১২ টার আগেই পৌছাতে হবে, এবং পৌঁছে নোটিশ অফ রেডিনেস বা আমরা যে প্রস্তুত জানাতে হবে। এক ঘণ্টা পরেই এঙ্কর উঠিয়ে ফেলা হল, তখনো আমাদের কার্গো হোস পাইপ বিযুক্ত করা হয় নি। সময় বাচানোর জন্য নোঙর তুলে চলতে চলতে পাইপ খুলে নেয়া হল। সাড়ে নটায় রশি খোলা শুরু, আধা ঘণ্টার মধ্যেই সব বাধন মুক্ত। কিন্তু মুক্ত অবস্থায় থাকলেও জাহাজ দুটি গায়ে গায়ে লেগে থাকে, খুবই ধীরে ধীরে চলতে চলতে আলাদা হয়ে যায়। একটু উনিশ বিশ হলে একটার গায়ে আরেকটা বাড়ি খাবে। দুটো জাহাজের ইঞ্জিনই চলতে থাকে, এর মধ্যে ভরা জাহাজ টি একটু আস্তে চালানো হয়, হালকা মানে যে জাহাজ কার্গো খালি হয়ে গেছে সে একটু দ্রুত চালিয়ে ধীরে ধীরে একটার গায়ে থেকে আরেকটা আলাদা হয়ে যাবে। বাধন খোলার ১৫ মিনিট এর মধ্যেই আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। আলাদা হয়ে ২ কিমি দূরে গিয়ে আবার থামানো হল, আমাদের পাইলট তার মাল সামান নিয়ে নীচে নেমে যাবে, এসব পাইলট আবার সিঁড়ি দিয়ে নামবে না। তার নামার ব্যবস্থা হল একটি পাখির খাঁচার মত খাঁচা থাকে।

এটা কে আমরা ক্রেন এর সাহায্যে ঝুলিয়ে জাহাজের বাইরে নামিয়ে দেই, যে লঞ্চ বা ওয়ার্ক-বোট আমাদের লাইটারিং এর কাজে সাহায্য করে, সেটি এসে নীচে দাঁড়াবে, আমরা উপর থেকে খাঁচাটি ধীরে ধীরে সেই বোটে নামিয়ে দেব। তাকে নামিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই পূর্ণ গতিতে ছোটা শুরু করলাম পরের জাহাজের দিকে। আমাদের ভাড়ার চুক্তি অনুযায়ী একটি পজিশন দেয়া আছে, এ জায়গায় পৌঁছে আমাদের ঘোষণা করতে হবে যে আমরা চুক্তি মাফিক পৌঁছে গেছি এবং লোডিং করার জন্য প্রস্তুত। সবাই জানে যে আজকে লোডিং হবেনা, কিন্তু আমাদের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হবে।

রাত সাড়ে এগারোটায় পৌঁছে গেলাম জায়গা মত, রীতি অনুযায়ী মেইল করে দিলাম যে ‘আমি ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, আমার জাহাজ ‘এমটি অমুক’ নিয়ে স্থানীয় সময় ২৩:৩০, জিএমটি সময় ০৫:৩০ তে **** ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ, ***** ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ তে পৌঁছেছি এবং আমাদের চুক্তি মোতাবেক কার্গো লোড করার জন্য সর্বাঙ্গীণ ভাবে প্রস্তুত”। এর পরেই জাহাজ আস্তে আস্তে থামিয়ে দিলাম, ঠিক বারটা বাজে নামালাম নোঙর, সাথে সাথে পরিসমাপ্তি হল আমার ৭৭তম দিনের। ৭৭ তম দিন শুরু হলেও আমার কাজ শেষ হয় নি, এখন সবাইকে আগের লাইটারিং এর সমস্ত ঘটনার বিবরণ জানিয়ে মেইল করতে হবে, কখন কার্গো শেষ হয়েছে, কখন বাধন মুক্ত হয়েছে, কখন পাইলট নেমেছে এসব বিস্তারিত জানাতে হবে, এই সময় গুলির সাথেই আমাদের ভাড়া হিসেব করা হবে।

তার পরের কাজ হল এই ডিসচারজিং সম্পর্কিত যত কাগজ পত্র হয়েছে, আমাদের জাহাজে কত কার্গো ছিল, ডিসচারজিং এর পর কিছু বাকি ছিল কিনা, আমাদের ট্যাংক যে একদম খালি, আমাদের পাম্প কত বেগে চলেছে, প্রতি ঘন্টায় আমরা কত কার্গো ডিসচার্জ করেছি, কেন আরও দ্রুত করতে পারিনি এসব সমস্ত কিছুর যত নথিপত্র আছে সেগুলি স্ক্যান করে মেইল করতে হবে। এর পর পরের খদ্দের বা চার্টারার কে জানাতে হবে যে আমরা এতটার সময় এসেছি, যেহেতু পরবর্তী কোন নির্দেশনা পাইনি, তাই এই পজিশনে নোঙর করে আদেশের অপেক্ষায় আছি। শুতরাং আজকের মত এখানেই শেষ, শুভ রাত্রি। (১৮ ডিসেম্বর, ২০১৭ ভাসমান ৭৭ দিন: সোমবার)।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে