বাস্তবায়ন নিয়ে বাড়ছে হতাশা : পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২ দশক

0
766
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তিতে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পাহাড়ি জনপদে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন হতাশাই দেখা দিয়েছে। ছবি : ইন্টারনেট

সত্রং চাকমা, রাঙামাটি : ‘২০ বছর অনেক সময়।’ রাঙামাটি শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের মগবান ইউনিয়নের কুকিছড়া গ্রামের বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ চন্দ্র সেন চাকমা বলছিলেন, ‘২০ বছরে একটা ছোট বাচ্চাও বড় হয়ে নিজের ঠিকানা খুঁজে নিতে পারে।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তিতে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পাহাড়ি জনপদে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন হতাশাই দেখা দিয়েছে। রাঙামাটি শহরের তিন কিলোমিটার দূূরে মিতিঙ্গাছড়ি গিয়ে আলাপ হলো সেখানকার বাসিন্দা সাধন চাকমা, সুনীতি বিকাশ চাকমা ও বাবুল চাকমার সঙ্গে। তাদের একজন বললেন, ‘সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে; কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখিনি। সরকার যদি চুক্তি বাস্তবায়ন করত, তা হলে আমাদের জায়গাজমি হারাতে হতো না। চুক্তির ফলে একটাই লাভ হয়েছে- চলতে-ফিরতে আগের মতো তেমন একটা ধরাবাধা নেই।’

চুক্তি নিয়ে পাহাড়িদের মধ্যে এমন হতাশা ও উদ্বেগের মধ্যে আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই দশক পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে। পাহাড়ি তিন জেলায় দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এ চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালে জনসংহতি সমিতির তৎকালীন শান্তি বাহিনীর প্রায় দুই হাজার সদস্য সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

এদিকে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষ দুটির মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) বলছে, পার্বত্য চুক্তির দুই দশক হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে সরকারপক্ষ বলছে, চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে।

পার্বত্য চুক্তির দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে গত ২৯ নভেম্বর ঢাকায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পিসিজেএসএসের সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, সরকার শুধু পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় ফেলে রাখেনি, একের পর এক চুক্তিবিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। তিনি চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অসহযোগ ও বৃহত্তর আন্দোলনসহ তিন দফা কর্মসূচিরও ঘোষণা দেন।

এ প্রসঙ্গে সরকারি দলের পার্বত্য অঞ্চলের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, এরই মধ্যে সরকার পার্বত্য চুক্তির ৪৮টি ধারা পূর্ণাঙ্গ ও ১৯টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত করেছে। বাকি নয়টি ধারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়নের দাবি তারা কখনোই করেননি। তারা বলেছেন, সরকারের আন্তরিক উদ্যোগের সঙ্গে সব পক্ষের ইতিবাচক মনোভাব যদি না থাকে, তা হলে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করা কঠিন। কিন্তু এখানে এখনও চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের নামে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি রয়ে গেছে। অবৈধ অস্ত্রের কাছে পার্বত্য এলাকাবাসী জিম্মি হয়ে আছে।

চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, অঙ্ক কষে চুক্তির কয়টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে এবং কয়টি হয়নি, তা বোঝানো যাবে না। তবে চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে কিছু বিষয় একেবারেই বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে সবচেয়ে জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

পার্বত্য নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদকে যে ক্ষমতা দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হয়নি। জেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়ার কারণে এটি গণমুখী ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠছে না। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই দশক উপলক্ষে চুক্তি সম্পাদনকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রকাশিত বুকলেটে দাবি করা হয়েছে, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান এখনও অর্জিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সংবলিত বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়নি। তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, মাধ্যমিক শিক্ষাসহ সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম এখনও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন করা হয়নি। সেটেলার বাঙালি, অস্থানীয় ব্যক্তি ও কোম্পানিসহ সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভূমি দখল বন্ধ হয়নি। ভূমি কমিশনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি একটি সমস্যারও।

সাফল্যের মুখ দেখেনি ভূমি কমিশন :পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে চুক্তির আলোকে ২০০১ সালের ২০ জুন প্রণীত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। এর পর এ আইনের আলোকে তিন বছর মেয়াদি মোট ছয়টি কমিশন গঠিত হলেও দীর্ঘ ১৮ বছরেও ভূমিবিরোধ-সংক্রান্ত একটি কাজেরও অগ্রগতি হয়নি। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ার উল হককে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। তিনি চেয়ারম্যান থাকার সময়ই বিরোধপূর্ণ ভূমির বিষয়ে তিন পার্বত্য জেলা থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছিল। তবে কাজে কোনো অগ্রগতি আসেনি। খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের কার্যালয় স্থাপন করা হলেও পর্যাপ্ত জনবল ও তহবিল নেই। তহবিল, জনবল ও পরিসম্পদের অভাবে এখনও রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলায় শাখা কার্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। গত ৬ সেপ্টেম্বর কমিশনের চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনও নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এদিকে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রণীত হলেও ১৯টির মধ্যে ১৩টি ধারা বিরোধাত্মক থাকায় এগুলোর সংশোধন নিয়ে সরকার ও পিসিজেএসএসের ঐকমত্যে পৌঁছতে বেশ সময় লাগে। পরে ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন পাস হয়। এ প্রসঙ্গে পার্বত্য ভূমি কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, অনেক বছর পর হলেও ভূমি কমিশনের আইন সংশোধন করা হয়েছে। তবে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন যোগ্য ও নিরপেক্ষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে এ কমিশনে নিয়োগ দেওয়া। এ ছাড়া কমিশনের জনবলের সংকট রয়েছে। কমিশনের কাছে ২৬ থেকে ২৭ হাজারের মতো দরখাস্ত জমা পড়েছে। সেগুলো যাছাই-বাছাই করা একজন কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব নয়।

বর্ষপূর্তিতে পৃথক সমাবেশ :পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও আওয়ামী লীগ পৃথক সমাবেশের আয়োজন করেছে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিজেএসএসের উদ্যোগে শহরের জিমনেসিয়াম চত্বরে জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশে উষাতন তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ানসহ বিশিষ্ট নেতারা উপস্থিত থাকবেন। অন্যদিকে, জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আনন্দ র‌্যালি ও আলোচনা সভার কর্মসূচি রয়েছে। লেখক-সত্রং চাকমা, রাঙামাটি। সূত্র: দৈনিক সমকাল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে