প্রকল্পের জনবলকে অবৈধভাবে ক্যাডারভুক্তি: ক্ষোভে ফুঁসছেন সমবায় অধিদপ্তরে বিসিএস কর্মকর্তারা

0
3766

তেত্রিশ বছর আগে সমবায় অধিদপ্তরের অস্থায়ী একটি প্রকল্পে ৪৯ জন সহকারী নিবন্ধক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন । প্রকল্প শেষে নিয়ম অনুযায়ী তাদের চাকরিও শেষ হয়। চাকরি থেকে ছাটাই হওয়ার ছয় মাস পর এর মধ্যে ৩০ জনকে আবারও অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে দেখা যায় সংস্থাপন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ বিভাগের সম্মতিতে প্রকল্পটি ১৯৮৯-১৯৯৪ অর্থ বছর পর্যন্ত রাজস্ব বাজেটের আওতায় আসায় উক্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ৩০ জন কর্মকর্তাকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত সাপেক্ষে সমবায় অধিদপ্তরের বিশেষ অডিট সেলে নিয়োগ প্রদান করা হয় এবং চাকরি নিয়মিতকরণ করা হয় ।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব জনাব আইয়ূব কাদরী বাংলাদেশ সরকারী কর্মকমিশন সচিবালয়ের চাকুরী নিয়মিতকরণের সুপারিশের প্রেক্ষিতে কোন এক অজ্ঞাত কারণে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে উক্ত ১৮ জন কর্মকর্তাকে বিসিএস সমবায় (ক্যাডার) পদের বিপরীতে নিয়মিত করে তাদেরকে উক্ত ক্যাডার পদে নিয়োগ করেন।

বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮১ অনুযায়ী একমাত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কেই রাষ্ট্রপতি বিসিএস (ক্যাডারভুক্তি) করণের পাওয়ার ডেলিগেশন করেছে। এবং সেখানে পিএসসিএর সুপারিশের প্রেক্ষিতে কাউকে বিসিএস ক্যাডারে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে নিয়োগ প্রজ্ঞাপন জারী করবেন। এখন প্রকল্পভুক্ত ব্যক্তিগণই সমবায় অধিদপ্তরের বড় কর্মকর্তা এবং অধিদপ্তরকে তারাই অর্থ এবং ক্ষমতার জোরে তারাই অবস্থাদৃষ্টে অধিদপ্তর চালাচ্ছেন বলে ক্যাডারভুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান। জ্যেষ্ঠদের বাদ দিয়ে তাদের পদোন্নতি দিয়ে উচ্চতর পদে বসানো হচ্ছে। এ সবকিছুই অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, অসন্তোষ ও হতাশা বিরাজ করছে। এ বিষয়ে কথা বলতে সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল মজিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। তবে অধিদপ্তরের ক্যাডারভুক্ত একজন সিনিয়র কর্বমকর্তা বলেন, ১৯৯৬ সালের বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী তাদের ক্যাডারভুক্ত করা হয়নি। এ নিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তা অতীতে আদালতে দুটি রিটও করেছিলেন। কিন্তু ওই সময় সমবায় কর্তৃপক্ষ ও অবৈধভাবে ক্যাডারভুক্ত হওয়া কর্মকর্তাদের অনুরোধ-উপরোধের কারণে সেই রিট তুলে নেওয়া হয়। তখন কর্তৃপক্ষ বলেছিল, তারা কেবল ক্যাডারভুক্ত হয়েই থাকবেন; অডিট সেলের বাইরে কোনো পদে তাদের বসানো হবে না।

কিন্তু যখন তাদের পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপুর্ণ পদে বসানো শুরু হয়, তখনই অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। এ কারণেই একই সাথে মন্ত্রণালয় পদোন্নতির তিনটি প্রজ্ঞাপন জারী হলেও মন্ত্রীর গোচরীভূত হলে কর্তৃপক্ষ আবার তা স্থগিত করেছে বলেও জানান তিনি। জানা যায়, সমবায় অধিদপ্তরের পল্লী উন্নয়ন-২ প্রকল্পে ১৯৮৪ সালে তিন ধাপে ৪৯৭ জনকে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে ৭৫০ টাকা বেতন স্কেলে সহকারী নিবন্ধক (অডিট সেল) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে তাদের চাকরি শেষ হয়। কিন্তু ১৯৯০ সালের ৮ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. সিরাজউদ্দৌলার স্বাক্ষরে তাদের ৩০ জনকে নয়টি শর্ত দিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরিতে বহাল করা হয়।

শর্তগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রতি তিন বছর পরপর সরকারের অনুমতিক্রমে তাদের বেতন নবায়ন হবে। তারা কখনোই ক্যাডারভুক্ত হতে পারবেন না। বিশেষ অডিট সেলের আওতায় তাদের কাজ করতে হবে। এ প্রকল্প অবলুপ্ত হলে সরকার তাদের চাকরি থেকে বিদায় করে দেবে। সমবায় অধিদপ্তরের একটি সুত্র জানায়, ওই ৩০ জন ১৯৯৬ সালে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে পিএসসিতে তাদের ক্যাডারভুক্তির জন্য প্রস্তাব পাঠান।

১৯৯৬ সালের ২১ মার্চ ১৮ জনের চাকরি নিয়মিত করা যায় বলে মত দেয় পিএসসি। এরপরই ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় অবৈধভাবে তাদের ক্যাডারভুক্তির আদেশ জারি করে। ডেলিগেশন অব পাওয়ার এর ক্ষমতাবলে পিএসসির সুপারিশ বলে একমাত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ই ক্যাডারভুক্ত করার অধিকার সংরক্ষণ করে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ নয়।

এ তালিকারই ৭ নম্বরে থাকা আবু ফারুখ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে ২০১৪ সালে পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নিলে বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নজরে আসে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হাবিব মো. হালিমুজ্জামান স্বাক্ষরিত মতামতে বলা হয় :বর্ণিত প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮১-এ প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়ন ছাড়া ক্যাডারভুক্ত করা হয়েছে, যা বিধিসম্মত নয়। এ জন্য বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮১-তে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা প্রয়োজন।

অথচ নিয়ম লঙ্ঘন করে ক্যাডারভুক্ত হওয়া এসব কর্মকর্তাকে নানা সময়ে যুগ্ম নিবন্ধক হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি জ্যেষ্ঠ ১২ জনকে ডিঙিয়ে ১৩ নম্বরে থাকা যুগ্ম নিবন্ধক মোমিনুল হক তালুকদারকে অতিরিক্ত নিবন্ধকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দু’জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে গালিব খানকে করা হয় উপনিবন্ধক। এ ছাড়া অন্যদেরও পদোন্নতি দিয়ে বিভিন্ন স্থানে যুগ্ম নিবন্ধকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সমবায় অধিদপ্তরের যুগ্ম নিবন্ধক মো. শামীম রেজা বলেন, ‘এর আগে আমি একটি রিট করেছিলাম। তখন তারা হাতে-পায়ে ধরে বলেছিল, চাকরি করে খাচ্ছেন; রিটটা না তুললে তাদের সমস্যা হবে। এ জন্য রিটটি তুলে নিই। পিএসসির মাধ্যমে ক্যাডারভুক্ত করতে হলে পরীক্ষা দিতে হয়। তাদের সেই পরীক্ষাও নেওয়া হয়নি। পুরোটাই অবৈধভাবে হয়েছে। এ জন্য আমরা পুনরায় আদালতে যাব।’

নিয়ম লংঘন করে ক্যাডারভুক্ত হওয়াদের একজন মোমমিনুল হক তালুকদার বলেন, বিসিএস ক্যাডারভুক্তরা বরাবরই আমাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করে আসছেন। অথচ সব নিয়ম মেনেই আমাদের প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতভুক্ত করা হয়েছিল। পরে সব নিয়ম মেনেই ক্যাডারভুক্ত করা হয় এবং বলা হয়, প্রকল্পের চাকরির শুরু থেকে তাদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ হবে। তারপরও তার ১১ বছর বাদ দেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি তারা এ ধরনের কথা বলে, তাহলে কিছু বলার নেই। কিন্তু প্রাপ্ত রেকর্ডদৃষ্টে জনাব মোমিনের এই বক্তব্যের কোন ভিত্তি নেই।

অন্যদিকে, সরাসরি বিসিএস (সমবায়) ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তা বলছেন যদি মন্ত্রণালয় বিষয়টি সঠিকভাবে সুরাহা না করে তবে তাদের আদালতের আশ্রয় নেয়া ছাড়া কোন গত্যান্তর থাকবেনা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে