চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত

1
532

{CAPTION}
বিদ্যমান অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং আমদানি-রপ্তানির ক্রমবর্ধমান চাপ ও পণ্য ডেলিভারির দৈনন্দিন চাহিদার মুখে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা দ্রুত কমে যাচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে বন্দর ব্যবহারকারী, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের মুখে বন্দরের সার্বিক সম্প্রসারণ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা সময় বিবেচনায় শ্লথ ও সামান্য মনে করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ইকুইপমেন্ট সংকটের কথা বারবার বলা হলেও এবং তা বন্দর কর্তৃপক্ষ স্বীকার করলেও ইকুপমেন্ট দ্রুত সংগ্রহে বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে। বন্দরের একজন কর্মকর্তার মতে, বন্দরের অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এনবিআর-এর ভিন্নমত বন্দরের কাজের গতিশীলতার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।
বন্দরে এখন পণ্য ও কন্টেইনারবাহী জাহাজের আনাগোনা প্রতি মাসে গড়ে ৫০টির স্থলে ৬৫টিতে উন্নীত হয়েছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবোঝাই কন্টেইনার ও খালি কন্টেইনারের হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণও আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপরীতে ইয়ার্ডসমূহে স্থান সংকট, ইকুপমেন্টের স্বল্পতা, কন্টেইনার জাহাজীকরণ ও বন্দর থেকে ডেলিভারি দেয়ার ক্ষেত্রে যানজট, অতিরিক্ত সময় লাগা এবং কখনো কখনো বন্দরে জাহাজের অবস্থানকালীন গড় সময় (টার্ন-এরাউন্ড টাইম) বেড়ে যাওয়ার অভিযোগও তুলছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিগত প্রায় ১০/১২ বছরে বন্দরে আমদানি-রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ বিবেচনায় আগামী বছর অর্থাত্ ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকে ২.৫ মিলিয়ন টিইইউস কন্টেইনার বা ২৫ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিপূর্বে বছরে ২০ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের রেকর্ড স্থাপন করলেও আসন্ন ২০১৮ সালের শেষ প্রান্তিকে বন্দরকে প্রায় ২৩ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। তারা এই বন্দরে হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধি বিবেচনা করছেন বছরে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ।
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, অব্যাহত প্রবৃদ্ধির কারণে ২০১৯ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সক্ষমতা হারাবে। এজন্য তিনি ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বে-টার্মিনাল দ্রুত বাস্তবায়ন, প্রকল্প বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্টসমূহ দ্রুত ক্রয়, বার্থ অপারেটরদেরকে তাদের নিজস্ব ইকুইপমেন্ট দিয়ে কাজ করার বিধান বাস্তবায়ন, বন্দরের কেনাকাটার প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন, বিভিন্ন বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মধ্যে মতবিরোধ দূর করা, বন্দর এলাকায় যানজট নিরসনে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন কার্যকর করার আহবান জানান।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারস এসোসিয়েশনের পরিচালক (প্রশাসন) অমীয় শংকর বর্মন ‘ইত্তেফাক’কে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। তবে তা এই বন্দরে এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে হচ্ছে না। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান যেই সুবিধা তা দিয়ে এই বন্দর দিয়ে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ইত্যাদি করা যাবে না। যদি করতে হয়, তবে আলাদা অবকাঠামো করতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বিকল্প মহাসড়ক তৈরি করতে হবে। সবকিছুর আগে সড়ক যোগাযোগকে উন্নত করতে হবে।
বাংলাদেশে প্রাইভেট আইসিডি এসোসিয়েশনের (বিকডা) সেক্রেটারি রুহুল আমিন শিকদার বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে যে অবকাঠামো আছে ইকুইপমেন্টের অভাবে তারই পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। জেটি ও ইয়ার্ডে বর্তমানে মোট চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ ইকুইপমেন্ট দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেন শুধু কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ডেডিকেটেড সিসিটি ও এনসিটি জেটির ব্যর্থগুলোতে বর্তমানে যেখানে ২২ থেকে ২৪টি রাবার টায়ার্ড্ গ্যানিট্রক্রেন (আরটিজি) দিয়ে কাজ চালানোর দরকার সেখানে রয়েছে এরকম মাত্র ১২টি গ্যানট্রিক্রেন। এরকম সবখানেই ইকুইপমেন্ট সংকট রয়েছে। প্রাইভেট আইসিডি থেকে কন্টেইনার নিয়ে বন্দরে ঢোকার পর প্রতিটি কন্টেইনার ক্যারিয়ারকে ইকুইপমেন্টের অভাবে ৪/৫ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বন্দরে কন্টেইনারের স্থান সংকুলানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ভিতরে-বাইরে সর্বমোট ২৫০০ একর ভূমি সংস্থানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে বেশ কিছু ভূমি হাতে এসে গেছে। অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা ভেঙে ১৬০০ একর ভূমি রিগেইন করা হবে। বে-টার্মিনালসহ অন্যান্য প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী ৬ মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় ভূমি বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে এসে যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঐ ভূমিতে ইয়ার্ড তৈরি করা হবে, যাতে ৫০ হাজার টিইইউস কন্টেইনার রাখা যায়। তিনি বলেন, বর্তমানে বন্দরে, বন্দরের পণ্য আনা-নেয়ার জন্য ডেডিকেটেড সড়ক নেই, সেই ধরনের একটি সড়ক ঐ ইয়ার্ডের পণ্য পরিবহনে কাজে আসবে। চিটাগাং পোর্ট এক্সেস সড়কটিই সেই কাজে লাগবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ চায় বন্দরের ডেলিভারি পয়েন্টটি বে-টার্মিনাল এলাকায় সরিয়ে নিতে। সেখানে ২০ শতাংশ ডেলিভারিও যদি সরানো যায়, তাহলে বর্তমান বন্দর এলাকা থেকে ৫০ শতাংশ ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনের আনাগোনা কমে যাবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি এলাকা, শেড ও সংরক্ষিত এলাকায় পণ্য ডেলিভারি নিতে প্রতিদিন পাঁচ হাজার কন্টেইনার ক্যারিয়ার রাপ্লিং ভেহিক্ল, কাভার্ডভ্যান ও বড় ট্রাক প্রবেশ করে, যা যানজট তৈরিসহ বন্দরের গতিশীলতাকে ব্যাহত করে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে প্রায় ৩৩ হাজার কন্টেইনার রাখা যায়। দু’-এক বছরের মধ্যেই বন্দর ইয়ার্ড গুরুতর স্থানসংকুলান সংকটে পড়বে।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে